পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

●: 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ধরণী পাঠ করছে কত যুগ থেকে। সেই পাঠ-করাট আমি মনে মনে চেয়ে দেখছি। স্বরলোকের বাণী পৃথিবীর বুকের ভিতর দিয়ে কণ্ঠের ভিতর দিয়ে রূপে রূপে বিচিত্র হয়ে উঠল। বনে বনে হল গাছ, ফুলে ফুলে হল গন্ধ, প্রাণে প্রাণে হল নিঃশ্বলিত, একটি চিঠির সেই একটিমাত্র কথা,—সেই আলো, সেই সুন্দর, সেই ভীষণ ; সেই হাসির ঝিলিকে ঝিকিমিকি, সেই কান্নার কাপনে ছলছল । এই চিঠি-পড়াটাই স্বাক্টর স্রোত,—যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে, সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ । সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ । কেননা দুর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না। স্বষ্টি-উৎসের মুখে কী একটা কাও আছে, সে এক ধারাকে দুই ধারায় ভাগ করে । বীজ ছিল নিতান্ত এক, তাকে দ্বিধা করে দিয়ে দুখানি কচি পাতা বেরল, তখনি সেই বীজ পেল তার বাণী ; নইলে সে বোবা, নইলে সে কৃপণ, আপন ঐশ্বর্য আপনি ভোগ করতে জানে না। বীজ ছিল এক, বিদীর্ণ হয়ে স্ত্রী-পুরুষে সে দুই হয়ে গেল । তখনি তার সেই বিভাগের ফাকের মধ্যে বসল তার ডাক-বিভাগ । ডাকের পর ডাক, তার অন্ত নেই । বিচ্ছেদের এই ফণক একটা বড়ো সম্পদ, এ নইলে সব চুপ সব বন্ধ। এই ফাকটার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অপেক্ষার ব্যথা একটা আকাজক্ষার টান টনটন করে উঠল, দিতে-চাওয়ার আর পেতে-চাওয়ার উত্তর-প্রত্যুত্তর এপারে-ওপারে চালাচালি হতে লাগল। এতেই দুলে উঠল স্বষ্টিতরঙ্গ, বিচলিত হল ঋতুপর্যায় ; কখনো বা গ্রীষ্মের তপস্ত, কখনো বর্ষার প্লাবন, কখনো বা শীতের সংকোচ, কখনো বা বসন্তের দাক্ষিণ্য । একে যদি মায়া বল তো দোষ নেই, কেননা এই চিঠি লিখনের অক্ষরে আবছায়া, ভাষায় ইশারা —এর আবির্ভাব-তিরোভাবের পুরো মানে সব সময়ে বোঝা যায় না । ষাকে চোখে দেখা যায় না, সেই উত্তাপ কথন আকাশ-পথ থেকে মাটির আড়ালে চলে যায় ; মনে ভাবি একেবারেই গেল বুঝি । কিছুকাল যায়, একদিন দেখি মাটির পর্দা ফাক করে দিয়ে একটি অঙ্কুর উপরের দিকে কোন-এক আর-জন্মের চেনা-মুখ খুজছে। যে-উত্তাপটা ফেরার হয়েছে বলে সেদিন রব উঠল, সেই তো মাটির তলার অন্ধকারে সেধিয়ে কোন ঘুমিয়ে-পড়া বীজের দরজায় বসে বসে ঘা দিচ্ছিল। এমনি করেই কত অদৃশ্য ইশারার উত্তাপ এক হৃদয়ের থেকে আর-এক হৃদয়ের ফ কে ফাকে কোন চোরকোঠায় গিয়ে ঢোকে, সেখানে কার সঙ্গে কী কানাকানি করে জানি নে, তার পরে কিছুদিন বাদে একটি নবীন বাণী পর্দার বাইরে এসে বলে, “এসেছি।” আমার সহযাত্রী বন্ধু আমার ডায়ারি পড়ে বললেন—তুমি ধরণীর চিঠি পড়ায় আর মানুষের চিঠি পড়ায় মিশিয়ে দিয়ে একটা যেন কী গোল পাকিয়েছ। কালিদাসের মেঘদূতে