পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

àR রবীন্দ্র-রচনাবলী যৎসামান্য ছিল। ঘটা করিয়া দুর্গোৎসব সম্পন্ন হইত, নিয়মিত পূজা-অৰ্চনাদনধ্যান ও আতিথ্যের ব্যয় ভিন্ন আর কোনো ব্যয়ই ছিল না। অনুপের মৃত্যুর পর অতিথিশালাটি বাবুর্চিখানা হইয়া দাড়াইল । ব্ৰাহ্মণগুলার জ্বালায় গোটা চারেক দরোয়ান রাখিতে হইল, তাহারা প্ৰত্যেক ভট্টাচাৰ্যকে রীতিমত অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা করিত এবং প্রত্যেক ভট্টাচাৰ্য বিধিমতে নরেন্দ্রকে উচ্ছিন্ন যাইবার ব্যবস্থা করিয়া যাইত। নরেন্দ্র গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি ডিসপেনসবি স্থাপন করিলেন। শুনিয়াছি নহিলে সেখানে ব্ৰান্ডি কিনিবার অন্য কোনো সুবিধা ছিল না। গবর্নমেন্টের সস্তা দোকান হইতে রায়বাহাদুরের খেলানা কিনিবার জন্য ঘোড়দৌড়ের চাঁদা পুস্তকে হাজার টাকা সই করিয়াছিলেন এবং এমন আরো অনেক সৎকাৰ্য করিয়াছিলেন যাহা লইয়া অমৃতবাজারের একজন পত্রপ্রেরক ভারি ধুমধাম করিয়া এক পত্ৰ লেখে। তাহার প্রতিবাদ ও তাহার পুনঃপ্রতিবাদের সময় অমূলক অপবাদ দেওয়া যে ভদ্রলোকের অকৰ্তব্য ইহা লইয়া অনেক তর্ক বিতর্ক হয়। নরেন্দ্রকে পল্লীর লোকেরা জাতিচু্যুত করিল, কিন্তু নরেন্দ্র সে দিকে কটাক্ষপাতও করিলেন না। নরেন্দ্র বাগবাজারে এক বাড়ি ভাড়া করিয়াছেন ও কাশীপুরে এক বাগান ক্রয় করিয়াছেন। একদিন । বাগবাজারের বাড়িতে সকলে বসিয়া নরেন্দ্র চা খাইতেছেন - নরেন্দ্রের সকাল ও আমাদের সকালে অনেক তফাত, সেদিন শনিবারে কুঠি যাইবার সময় দেখিয়া আসিলাম, নরেন্দ্রের নাক ডাকিতেছে। দুইটার সময় ফিরিয়া আসিবার কালে দেখি চােখ রগড়াইতেছেন, তখনো আন্তরিক ইচ্ছ। আর-এক ঘুম দেন। যাহাই হউক নরেন্দ্র চা খাইতেছেন এমন সময়ে সমাজসংস্কারক গদাধর বাবু, কবিতাকুসুমমঞ্জুরীপ্রণেতা কবিবার স্বরূপচন্দ্ৰবাবু, আসিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রথম অভ্যর্থনা সমাপ্ত হইলে সকলে চেয়ারে উপবিষ্ট হইলেন । নানাবিধ কথোপকথনের পর গদাধরবাবু কহিলেন, “দেখুন মশায়, আমাদের দেশের স্ত্রীলোকদের দশা বড়ো শোচনীয় ।” r এই সময়ে নরেন্দ্ৰ শোচনীয় শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করিলেন, স্বরূপচন্দ্রবাবু কহিলেন— “deplorable'।। নরেন্দ্রের পক্ষে উভয় কথাই সমান ছিল,কিন্তু নরেন্দ্র এই প্রতিশব্দটি শুনিয়া শোচনীয় শব্দের অর্থটা যেন জল বুঝিয়া গেলেন । গদাধরবাবু কহিলেন, “এখন আমাদিগের উচিত তাঁহাদের অন্তঃপুরের প্রাচীর ভাঙিয়া দেওয়া ।” অমনি নরেন্দ্ৰ গভীর ভাবে কহিলেন, “কিন্তু এটা কতদূর হতে পারে তাই দেখা যাক। তেমন সুবিধা পাইলে অন্তঃপুরের প্রাচীর অনেক সময় ভাঙিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করে বটে, কিন্তু পুলিসের লোকেরা তাহাতে বড়োই আপত্তি করিবে । ভাঙিয়া ফেলা দূরে থােক, একবার আমি অন্তঃপুরের প্রাচীর লঙ্ঘন করিতে গিয়াছিলাম, ম্যাজিষ্ট্রেট তাতে আমার উপর বড়ো সন্তুষ্ট হয় নাই।” - অনেক তর্কের পর গদাধর ও স্বরূপে মিলিয়া নরেন্দ্রকে বুঝাইয়া দিল যে, সত্যসত্যই অন্তঃপুরের প্রাচীর ভাঙিয়া ফেলিবার প্রস্তাব হইতেছে না- তাহার তাৎপর্য এই যে, স্ত্রীলোকদের অন্তঃপুর হইতে মুক্ত করিয়া দেওয়া । গদাধর বাবু কহিলেন, “কত বিধবা একাদশীর যন্ত্রণায় রোদন করিতেছে, কত কুলীনপত্নী স্বামী জীবিত-সত্ত্বেও বৈধব্যজ্বালা সহ্য করিতেছে।” স্বরূপবাবু কহিলেন, “এ বিষয়ে আমার অনেক কবিতা আছে, কাগজওয়ালারা তার বড়ো ভালো সমালোচনা করেছে। দেখো নরেন্দ্ৰবাবু, শরৎকালের জ্যোৎসারাত্রে কখনো ছাতে শুয়েছ ? চাদ যখন ঢলঢল হাসি ঢালতে ঢালতে আকাশে ভেসে যায়। তখন তাকে দেখেছি ? আবার সেই হাস্যময় চাদকে যখন ঘোর অন্ধকারে মেঘে আচ্ছন্ন করে ফেলে তখন মনের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট উপস্থিত হয়, তা মুলুঙ্গু করেছ। তা যদি করে থাকাে স্তরে বলে দেখি লােকের কষ্ট. দেখলে সেইরূপ কষ্ট श्श केि ना |” নরেন্দ্রের সম্মুখে এতগুলি প্রশ্ন একে একে খাড়া হইল, নরেন্দ্ৰ ভাবিয়া আকুল। অনেকক্ষণের পর