পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Σ δ Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী আড়াল হইতে শুনিতে পাইল, মনে মনে কহিল “ইহঁ— বুঝিয়েছি, এত লোক থাকিতে স্বরূপবাবুকে জিজ্ঞাসা করিতে পাঠানো কেন ! গদাধরবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেও তো চলিত।” একদিন করুণা ভবিকে কী কথা বলিতেছিল, দূর হইতে নিধি শুনিতে পাইল না, কিন্তু মনে হইল করুণা যেন একবার ‘স্বরূপবাবু বলিয়াছিল— আর-একটি প্রমাণ জুটিল। আর একদিন নরেন্দ্র স্বরূপ ও গদাধর বাগানে বসিয়াছিল, করুণা সহসা জানােলা দিয়া সেই দিক পানে চাহিয়া গেল, নিধি স্পষ্ট বুঝিতে পারিল যে করুণা স্বরূপেরই দিকে চাহিয়াছিল। নিধি এই তো তিনটি অকাট্য প্রমাণ পাইয়াছে, ইহা অন্য লোকের নিকট যাহাই হউক। কিন্তু নিধির নিকট ইহা সমস্তই পরিষ্কার প্রমাণ। শুদ্ধ ইহাই যথেষ্ট নহে, করুণা যে দিনে দিনে শীর্ণ বিষন্ন রুগণ হইয়া যাইতেছে, নিধি স্পষ্ট বুঝিতে পারিল তাহার কারণ আর কিছুই নয়- স্বরূপের ভাবনা । এখন স্বরূপের নিকট কথা আদায় করিতে হইবে, এই ভাবিয়া নিধি ধীরে ধীরে তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। হঠাৎ গিয়া কহিল, “করুণা তো, ভাই, তোমার জন্য একেবারে পাগল।” হল কেবারে সক্রিয়া উঠিল। আকাদেউলুঃ ইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী কবিয়া " নিধি মনে মনে কহিল, ‘হঁ-হঁ, আমি তোমাদের ভিতরকার কথা কী করিয়া সন্ধান পাইলাম ভাবিয়া ভয় পাইতেছ ? পাইবে বৈকি, কিন্তু নিধিরামের কাছে কিছুই এড়াইতে পায় না।’ কহিল, “জানিলাম, এক রকম করিয়া ।” |- বলিয়া চোখ টিপিতে টিপিতে চলিয়া গেল। তাহার পরদিন গিয়া আবার স্বরূপকে কহিল, “করুণার সহিত তুমি যে গোপনে গোপনে দেখাসাক্ষাৎ করিতেছ। ইহা নরেন্দ্ৰ যেন টের না পায় ।” স্বরূপ কহিল, “সেকি ! করুণার সহিত একবারও তো আমার দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা হয় নাই।” নিধি মনে মনে কহিল, ‘নিশ্চয় দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছিল, নহিলে এত করিয়া ভাড়াইবার চেষ্টা করিবে: কেন । ইহাও একটি প্রমাণ হইল, কিন্তু আবার স্বরূপ যদি বলিত যে, ‘ই দেখাসাক্ষাৎ হইয়াছিল। তবে তাহাও একটি প্রমাণ হইত । যাহা হউক, নিধির মনে আর সন্দেহ রহিল না। এমন একটি নিগুঢ় বার্তা নিধি আপনার বুদ্ধিকৌশলে জানিতে পারিয়াছে, এ কথা কি সে আর গোপনে রাখে। তাহার বুদ্ধির পরিচয় লোকে না। পাইলে আর হইল কী । ‘তুমি যাহা মনে করিতেছ। তাহা নয়, আমি ভিতরকার কথা সকল জানি’- চতুরতাভিমানী লোকেরা ইহা বুঝাইতে পারিলে বড়োই সন্তুষ্ট হয়। নিধির কাছে যদি বল যে, ‘রামহরিবাবু বড়ো সংলোক অমনি নিধি চমকিয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিবে, "কী বলিতেছ। কে সৎ লোক। রামহরিবাবু ? 'ও'- এমন করিয়া বলিবে যে তুমি মনে করিবে, এ বুঝি রামহরিবাবুর ভিতরকার কী একটা দোষ জানে। পীড়াপীড়ি করিয়া জিজ্ঞাসা করিলে কহিবে, “সে অনেক কথা ।” দুজনে গুপ্ত থকা পাইয়াছে তাঙ্ক পাল দ্বার স্থল থেকে বলবে এইরুপ ঘন ঘন রল । চতুৰ্দশ পরিচ্ছেদ । কয়দিন ধরিয়া ছােটাে ছেলেটির পীড়া হইয়াছে। তাহা হইবে না তো কী। কিছুরই তো নিয়ম, নাই | করুণা ডাক্তার ডাকাইয়া আনিল, ডাক্তার আসিয়া কহিল পীড়া শক্ত হইয়াছে। করুণা তো দিন হইল। গ্রামের নোটিব ডাক্তার কপালীচরণবাবু পীড়ার তত্ত্বাবধান করিতেছেন, তাহাকে ফি দিবার সময় তিনি কহিলেন, “থাক, থাক, পীড়া অগ্রে সারুক।” পণ্ডিতমহাশয় বুঝিলেন, নরেন্দ্রদের দুরবস্থা শুনিয়া দয়ার্ড ডাক্তারটি বুঝি ফি লাইতে রাজি নহেন। দুই বেলা তাহাকে ডাকাইয়া আনিলেন, তিনিও অমানবদনে আসিলেন ।