পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Σ δ δ করুণা যে কী করিবে কিছুই ভাবিয়া পায় না, ভয়ে বেচারি সারা হইতেছে। স্বরূপ রাত দিন খিটখিটে করে, এমন-কি, করুণাকে মাঝে মাঝে ধমকাইতে আরম্ভ করিয়াছে। করুণার কিছু বলিবার মুখ নাই, সে শুধু কঁদিতে থাকে। এইরূপে কত দিন যায়, স্বরূপের এলাহাবাদে যাইবার সময় হইয়াছে। সে ভাবিতেছে, “এখন করুণাকে লইয়া কী করি । এইখানে কি ফেলিয়া যাইব । না, এত করিয়া আনিলাম, গাড়িভাড়া দিলাম, এতদিন রাখিলাম, অবশেষে কি ফেলিয়া যাইব । আরো দিন-কতক দেখা যাক ৷” অনেক ভাবিয়া-সাবিয়া করুণাকে তো ডাকিল । করুণা ভাবিল, “যাইব কি না । কিন্তু না যাইয়াই বা কী করি। এখানে কোথায় থাকিব। এত দূর দেশে অচেনা জায়গায় কার কাছে যাইব । দেশে থাকিতাম। তবু কথা থাকিত ।” করুণা চলিল। উভয়ে স্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইল। গাড়ি ছাড়িতে এখনো দেরি আছে। জিনিসপত্র পুঁটুলি-বোেচকা লইয়া যাত্ৰিগণ মহা কোলাহল করিতেছে। কানো-কলম-গীেজ রেলওয়ে ক্লার্কগণ ভারি উচু চালে ব্যস্তভাবে ইতস্তত ফর ফর করিয়া বেড়াইতেছেন। পান সোডাওয়াটার নানাপ্রকার মিষ্টান্নের বোঝা লইয়া ফেরিওয়ালারা আগামী গাড়ির জন্য অপেক্ষা করিতেছে। এইরূপ তো অবস্থা। এমন সময়ে একজন পুরুষ করুণার পাশে সেই বেঞ্চে আসিয়া বসিল । করুণা উঠিয়া যাইবে-যাইবে করিতেছে, এমন সময়ে তাহার পার্শ্বস্থ পুরুষ বিস্ময়ের স্বরে কহিয়া উঠিল, “মা, তুমি যে এখানে ৷” . করুণা পণ্ডিতমহাশয়ের স্বর শুনিয়া চমকিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ কিছু বলিতে পারিল না। আমার ভাগ্যে কী ছিল |” পণ্ডিতমহাশয় তো আর অশ্রুসংবরণ করিতে পারেন না। গদগদ স্বরে কহিলেন, “মা, যাহা হইবার তাহা হইয়াছে, তাহার জন্য আর ভাবিয়ো না । আমি প্ৰয়াগে যাইতেছি, আমার সঙ্গে আইস । পৃথিবীতে আর আমার কেহই নাই— যে কয়টা দিন বঁাচিয়া আছি ততদিন আমার কাছে থাকো, ততদিন আর তোমার কোনো ভাবনা নাই ।” করুণা অধীর উচ্ছাসে কাদিতে লাগিল। এমন সময়ে নিধি আসিয়া উপস্থিত হইল। নিধি পণ্ডিতমহাশয়ের খরচে কাশী দর্শন করিতে আসিয়াছেন। পণ্ডিতমহাশয় তজ্জন্য নিধির কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আছেন । তিনি বলেন, নিধির ঋণ তিনি এ জন্মে শোধ করিতে পরিবেন না । করুণাকে দেখিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিল ; কহিল, “ভট্টাচাৰ্যমহাশয়, একটা কথা আছে।” পণ্ডিতমহাশয় শশব্যাস্তে উঠিয়া গেলেন। নিধি কহিল, “ঐ বাবুটিকে দেখিতেছেন ?” পণ্ডিতমহাশয় চাহিয়া দেখিলেন । দেখিলেন- স্বরূপ । নিধি কহিল, “দেখিলেন । করুণার ব্যবহারটা একবার দেখিলেন ! ছি-ছি, স্বগীয় কর্তার নামটা একেবারে ডুবাইল ।” পঞ্চমহাশয় অনেকক্ষণ ই কবিয়া দাঁড়ায় হলেন অবশেষে হাত উল্টইয়া আন্তে আন্তে “ন্ত্রিয়াশ্চরিত্রাং পুরুষস্য ভাগ্যং দেবা না জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ ।” নিধি কহিল, “আহা, নরেন্দ্র এমন ভালো লোক ছিল। ঐ রাক্ষসীই তো তাহাকে নষ্ট করিয়াছে।” নরেন্দ্ৰ যে ভালো লোক ছিল সে বিষয়ে পণ্ডিতমহাশয়ের সংশয় ছিল না, এখন যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহারও প্রমাণ পাইয়াছেন, কিন্তু এতক্ষণে কেন যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহার কারণটা জানিতে পারিলেন। পণ্ডিতমহাশয়ের স্ত্রীজাতির উপর দারুণ ঘূণা জন্মাইল। পণ্ডিতমহাশয় ভাবিলেন, আর না- স্ত্রীলোকেই তাহার সর্বনাশ করিয়াছে, শ্ৰীজাতিকে আর বিশ্বাস করবেন না ।