পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

soOvR » 8\9 করিল। মহেন্দ্ৰ বালিকার সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না- কিন্তু এই প্রশ্ন শুনিয়া তাহার চক্ষে জল আসিয়াছিল। নরেন্দ্রকে মহেন্দ্ৰ বেশ চেনে, সে সমস্ত ঘটনা বেশ বুঝিতে পারিল। পণ্ডিতমহাশয় যে কেন তাহাকে আমন করিয়া ফেলিয়া গেলেন তাহাও করুণা ভাবিয়া পাইতেছিল না, অনেকক্ষণ ভাবিয়া ভাবিয়া তাহাও মহেন্দ্ৰকে জিজ্ঞাসা করিল। মহেন্দ্র তাহার যথার্থ কারণ যাহা বুঝিয়াছিলেন তাহা গোপন করিয়া নানারূপে বুঝাইয়া দিলেন। এখন করুণাকে লইয়া যে কী করিবে মহেন্দ্র তাঁহাই ভাবিতে লাগিল। অবশেষে স্থির হইল তাহদের বাড়িতেই লইয়া যাইবে । মহেন্দ্র করুণার নিকট তাহার বাড়ির বর্ণনা করিল। কহিলতাহাদের বাড়ির সামনেই একটি প্রাচীর-দেওয়া বাগান আছে, বাগানের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র পুষ্করিণী আছে, পুষ্করিণীর উপরে একটি বাধানো শানের ঘাট । কহিল— তাহাদের বাড়িতে গেলে করুণা তাহার একটি দিদি পাইবে, তেমন স্নেহশালিনী- তেমন কোমলহৃদয়- তেমন (আরো অসংখ্য বিশেষণ প্রয়োগ করিয়াছিল) দিদি কেহই কখনো পায় নাই। করুণা আমনি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিল সেখানে কি ভবির দেখা পাইবে ! মহেন্দ্র ভবির সন্ধান করিবে বলিয়া স্বীকৃত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন করুণা তাহাকে ভ্রাতার মতো দেখিবে কি না, করুণার তাহাতে কোনো আপত্তি ছিল না। যাহা হউক, এতদিন পরে করুণার মুখ প্রফুল্প দেখিলাম, এতদিন পরে মে তবু আশ্রয় পাইল। কিন্তু বারবার করুণা মহেন্দ্রকে পণ্ডিতমহাশয়ের তাহার উপর রাগ করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছে। অবশেষে তাহারা যাইবার জন্য প্ৰস্তুত হইল । কাশী পরিত্যাগ করিয়া চলিল । কে কী বলিবে, কে কী করিবে, কখন কী হইবে- এই সমস্ত ভাবিতে ভাবিতে ও যদি কেহ কিছু বলে তবে তাহার কী উত্তর দিবে, যদি কেহ কিছু করে তবে তাহার কী প্রতিবিধান করিবে, যদি কখনো কিছু হয় তবে সে অবস্থায় কিরূপ ব্যবহার করিবে--- এই সমস্ত ঠিক করিতে করিতে মহেন্দ্র গ্রামের রাস্তায় গিয়া পৌঁছিল। লজ্জায় ক্ৰিয়মাণ হইয়া, সংকোচে অভিভূত হইয়া, পথিকদিগের চক্ষু এড়াইয়া ও কোনোমতে পথ পার হইয়া গৃহের দ্বারে গিয়া উপস্থিত হইল। কতবার সাত-পাচ করিয়া পরে প্রবেশ করিল। দাদাবাবুকে দেখিয়াই বি বঁটা রাখিয়া ছুটিয়া বড়োমাকে খবর দিতে গেল। বড়োমা তখন রজনীর সুমুখে বসিয়া রজনীর রূপের ব্যাখ্যান করিতেছিলেন, এমন সময়ে খবর পাইলেন যে আর-একটি নূতন বধু লইয়া তাহার ‘বাবা' ঘরে আসিয়াছেন । মহেন্দ্রের ও করুণার সহিত সকলের সাক্ষাৎ হইল, যখন সকলে মিলিয়া উলু দিবার উদযোগ করিতেছেন এমন সময়ে মহেন্দ্র তাহাদিগকে করুণা-সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার খুলিয়া বলিল। সে-সমস্ত বৃত্তান্ত মহেন্দ্রের মাতার বড়ো ভালো লাগে নাই। মহেন্দ্রের সম্মুখে কিছু বলিলেন না, কিন্তু সেই রাত্রে যে এই সমস্ত বিপত্তির কারণ তাহা অবধারিত হইয়া গিয়াছিল। এই কথাটা লইয়া মহেন্দ্রের-পিতার অতিরিক্ত আনা-দুয়েকের তামাকু ব্যয় হইয়াছিল ও দুই-চারিজন বৃদ্ধ বিজ্ঞ প্রতিবাসীদিগের মাথা ঘুরিয়া গিয়াছিল, কিন্তু আর অধিক কিছু দুর্ঘটনা হয় নাই। রজনী তাহার দিদির বাড়ি যাইবার সমস্তই বন্দোবস্ত করিয়াছিল, তাহার শ্বশুর শাশুড়িরা এই বন্দােবস্তে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন, কিন্তু রজনী বড়ো দুর্বল বলিয়া এখনাে সমাধা হইয়া উঠে নাই। এই খবরটি আসিয়াই মহেন্দ্ৰ তাহার মাতার নিকট হইতে শুনিতে পাইলেন । আশ্চর্যের স্বরে কহিলেন, “দিদির বাড়ি যাইবে, তার অর্থ কী । আমি আসিলাম আর অমনি দিদির বাড়ি যাইবে ।” মহেন্দ্রের মাও অবাক, মহেন্দ্রের পিতা কিছুক্ষণ অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন- পরে ঠুঙি হইতে চশমা বাহির করিয়া পরিলেন এবং মহেন্দ্ৰকে দেখিতে লাগিলেন- যেন তিনি মিলাইয়া দেখিতে চান যে এ মহেন্দ্রের সহিত পূর্বকার মহেন্দ্রের কোনাে আদল আছে কি না ! এ মহেন্দ্ৰ কুঁটা মহেন্দ্র কি না ! মহেন্দ্র অধিক বাক্যব্যয় না করিয়া তৎক্ষণাৎ রজনীর ঘরে চলিয়া গেলেন ও কর্তা গৃহিণীতে মিলিয়া