পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ S ૨છે পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ আজকাল রজনী ভারি গিন্নি হইয়াছে। এখন তাহার হাতে টাকাকড়ি আসে । পাড়ার অধিকাংশ বুদ্ধা ও প্রৌঢ়া গৃহিণীরা রজনীর শাশুড়ির সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া শিঙ ভাঙিয়া রজনীর দলে মিশিয়াছেন। তাহারা ঘণ্টাখানেক ধরিয়া রজনীর কাছে দেশের লোকের নিন্দা করিয়া, উঠিয়া যাইবার সময় হাই তুলিতে তুলিতে পুনশ্চ নিবেদনের মধ্যে আবশ্যকমত টাকাটা-শিকিটা ধার করিয়া লইতেন এবং রজনীর স্বামীর, রজনীর উচ্চবংশের ও চােখের জল মুছিতে মুছিতে রজনীর মৃত লক্ষ্মীস্বভাবা মাতার প্রশংসা করিয়া শীঘ্র সে ধারগুলি শুধিতে না হয় এমন বন্দোবস্ত করিয়া যাইতেন । কিন্তু এই পিসি-মাসি শ্রেণীর মধ্যে করুণার দুর্নােম আর ঘুচিল না । ঘুচিবে কিরূপে বলে । মাসি যখন সন্তোষজনকরপে ভূমিকাটি শেষ করিয়া রজনীর কাছে কাজের কথা পাড়িবার উপক্ৰম করিতেছেন, এমন সময়ে হয়তাে করুণা কোথা হইতে তাড়াতাড়ি আসিয়া রজনীকে টানিয়া লইয়া বাগানে চলিল। মাঝে মাঝে তাহারা করুণার ব্যবহার দেখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, “তুমি কেমন-ধারা গা ?’ সে যে কেমন-ধারা করুণা তাহার কোনো হিসাব দিতে চেষ্টা করিত না । কোনো পিসির বিশেষ কথা, বিশেষ অঙ্গভঙ্গি বা বিশেষ মুখশ্ৰী দেখিলে এক-এক সময় তাহার এমন হাসি পাইত যে, সে সামলাইয়া উঠা দায় হইত, সে রজনীর গলা ধরিয়া মহা হাসির কল্লোল তুলিত- রজনী-সুদ্ধ বিব্রত হইয়া। উঠিত। তাহা ছাড়া রজনীর গিন্নিপনা দেখিয়া সে এক-এক সময়ে হাসিয়া আর বাচিত না। কিছুদিন হইতে মহেন্দ্ৰ দেখিতেছেন বাড়িটা যেন শান্ত হইয়াছে। করুণার আমোদ আহলাদ থামিয়াছে। কিন্তু সে শান্তি প্রার্থনীয় নহে— হাস্যময়ী বালিকা হাসিয়া খেলিয়া বাড়ির সর্বত্ৰ যেন উৎসবময় করিয়া রাখিত— সে একদিনের জন্য নীরব হইলে বাড়িটা যেন শূন্য-শূন্য ঠেকিত, কী যেন অভাব বোধ হইত। কয়দিন হইতে করুণা এমন বিষন্ন হইয়া গিয়াছিল- সে এক জায়গায় চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত, কঁাদিত, কিছুতেই প্ৰবোধ মানিত না । করুণা যখন এইরূপ বিষগ্ন হইয়া থাকে তখন রজনীর বড়ো কষ্ট হয়— সে বালিকার হাসি আহলাদ না দেখিতে পাইলে সমস্তদিন তাহার কেমন কোনো কাজই হয় না । নরেন্দ্রের বাড়ি যাইবে বলিয়া করুণা মহেন্দ্ৰকে ভারি ধরিয়া পড়িয়াছে। মহেন্দ্ৰ বলিল, সে বাড়ি অনেক দূরে। করুণা বলিল, তা হােক। মহেন্দ্ৰ কহিল, সে বাড়ি বড়ো খারাপ। করুণা কহিল, তা হােক ! মহেন্দ্ৰ কহিল, সে বাড়িতে থাকিবার জায়গা নাই। করুণা উত্তর দিল, তা হােক! সকল আপত্তির বিরুদ্ধে এই ‘তা হােক শুনিয়া মহেন্দ্ৰ ভাবিলেন, নরেন্দ্রকে একটি ভালো বাড়িতে আনাইবেন ও সেইখানে করুণাকে লইয়া যাইবেন । নরেন্দ্রের সন্ধানে চলিলেন । বাড়িভাড়া দিবার সময় হইয়াছে বলিয়াই হউক বা মহেন্দ্ৰ তাহার বাড়ির ঠিকানা জানিতে পারিয়াছে জুলাই ভুক্তি, নরেন্দ্র সে বাড়ি হইতে উঠিয়া গিয়াছেন। মহেন্দ্র গুহার বুধ অন্বেষণ করলেন। ● | এই বার্তা শুনিয়া অবধি করুণার আর হাসি নাই। বিশেষ অবস্থায়, বিশেষ সময়ে সহসা এক-একটা কথা শুনিলে যেমন বুকে আঘাত লাগে, করুণার তেমনি আঘাত লাগিয়াছে। কেন, এতদিনেও কি করুণার সহিয়া যায় নাই। নরেন্দ্র করুণার উপর কত শত দুর্ব্যবহার করিয়াছে, আর আজ তাহার এক স্থানান্তর সংবাদ পাইয়াই কি তাহার এত লাগিল। কে জানে, করুণার বড়ো লাগিয়াছে। বোধ হয় ক্রমাগত জ্বালাতন হইয়া হইয়া তাহার হৃদয় কেমন জীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, আজ এই একটি সামান্য আঘাতেই ভাঙিয়া পড়িল। বােধ হয় এবার বেচারি করুণা বড়োই আশা করিয়াছিল যে বুঝি নরেন্দ্রের সহিত আবার দেখা-সাক্ষাৎ হইবে। তাহাতে নিরাশ হইয়া সে পৃথিবীর সমুদয় বিষয়ে নিরাশ হইয়াছে, হয়তাে এই এক নিরাশা হইতেই তাহার বিশ্বাস হইয়াছে তাহার আর কিছুতেই সুখ হইবে না ! করুণার মন একেবারে ভাঙিয়া পড়িল— যে ভাবনা করুণার মতো বালিকার মনে আসা প্রায় অসম্ভব, সেই মরণের ভাবনা তাহার মনে হইল। তাহার মনে হইল, এ সংসারে সে কেমন শ্ৰান্ত