পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>brの রবীন্দ্র-রচনাবলী তারা কেবল মানুষ নয়, তারা কুকুর বেড়াল ঘোড়া টিয়েপাখি কাকাতুয়া, তারা আসশেওড়ার-বেড়া-দেওয়া পানাপুকুর, তারা গোসাইপাড়ার পোড়ো বাগানে ভাঙাপাচিলা-ঘেঁষা পালতে-মাদার, গোয়ালঘরের আঙিনায় খড়ের গাদার গন্ধ, পাড়ার মধ্য দিয়ে হাটে যাওয়ার গলি রাস্তা, কামারশালার হাতুড়ি-পেটার আওয়াজ, বহুপুরোনো ভেঙে পড়া ইটের পাজা যার উপরে অশথগাছ গজিয়ে উঠেছে, রাস্তার ধারের আমড়াতলায় পাড়ার প্রৌঢ়দের তাসপাশার আডডা, আরো কত কীযা কোনো ইতিহাসে স্থান পায় না, কোনো ভূচিত্রের কোণে আঁচড় কাটে না । এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পৃথিবীর চারি দিক থেকে নানা ভাষায় সাহিত্যলোকের বাস্তবের দল। ভাষার বেড়া পেরিয়ে তাদের মধ্যে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয় খুশি হয়ে বলি "বাঃ বেশ হল, অর্থাৎ মিলছে প্ৰাণের সঙ্গে, মনের সঙ্গে । তাদের মধ্যে রাজাবাদশা আছে, দীনদুঃখীও আছে, সুপুরুষ আছে, সুন্দরী আছে, কানা খোড়া কুঁজো কুৎসিতও আছে ; এইসঙ্গে আছে অদ্ভুত সৃষ্টিছাড়া, কোনো কালে বিধাতার হাত পড়ে নি যাদের উপরে, প্ৰাণীতত্ত্বের সঙ্গে শরীরতত্ত্বের সঙ্গে যাদের অস্তিত্বের অমিল, প্রচলিত রীতিপদ্ধতির সঙ্গে যাদের অমানান বিস্তর। আর আছে তারা যারা ঐতিহাসিকতার ভড়ং ক’রে আসরে নামে, কারও—বা মোগলাই পাগড়ি, কারও—বা যোধপুরী পায়জামা, কিন্তু যাদের বারো-আনা জাল ইতিহাস, প্ৰমাণপত্র চাইলে যারা নির্লজ্জভাবে বলে বসে ‘কেয়ার করি নে প্ৰমাণ- পছন্দ হয় কি না দেখে নাও" । এ ছাড়া আছে ভাবাবেগের বাস্তবতা— দুঃখ-সুখ বিচ্ছেদ-মিলন লজ্জা-ভয় বীরত্ব-কাপুরুষতা। এরা তৈরি করে সাহিত্যের বায়ুমণ্ডল— এইখানে রৌদ্রবৃষ্টি, এইখানে আলো-অন্ধকার, এইখানে কুয়াশার বিড়ম্বনা, মরীচিকার চিত্ৰকলা । বাইরে থেকে মানুষের এই আপন করে-নেওয়া সংগ্রহ, ভিতর থেকে মানুষের এই আপনারী-সঙ্গে-মেলানো সৃষ্টি, এই তার বাস্তবমণ্ডলী- বিশ্বলোকের মাঝখানে এই তার অন্তরঙ্গ মানবলোক- এর মধ্যে সুন্দর অসুন্দর, ভালো মন্দ, সংগত অসংগত, সুরওয়ালা এবং বেসুরো, সবই আছে ; যখনই নিজের মধ্যেই তারা এমন সাক্ষ্য নিয়ে আসে যে তাদের স্বীকার করতে বাধ্য হই, তখনই খুশি হয়ে উঠি । বিজ্ঞান ইতিহাস তাদের অসত্য বলে বলুক, মানুষ আপন মনের একান্ত অনুভূতি থেকে তাদের বলে নিশ্চিত সত্য। এই সত্যের বোধ দেয় আনন্দ, সেই আনন্দেই তার শেষ মূল্য । তবে কেমন করে বলব, সুন্দরবোধকে বোধগম্য করাই কাব্যের উদ্দেশ্য। বিষয়ের বাস্তবতা-উপলব্ধি ছাড়া কাব্যের আর-একটা দিক আছে, সে তার শিল্পকলা । যা যুক্তিগম্য তাকে প্ৰমাণ করতে হয়, যা আনন্দময় তাকে প্ৰকাশ করতে চাই । যা প্ৰমাণযোগ্য তাকে প্ৰমাণ করা সহজ, যা আনন্দময় তাকে প্রকাশ করা সহজ নয় । ‘খুশি হয়েছি। এই কথাটা বোঝাতে লাগে সুর, লাগে ভাবভঙ্গি । এই কথাকে সাজাতে হয়। সুন্দর করে মা যেমন করে ছেলেকে সাজায়, প্রিয় যেমন সাজায় প্রিয়াকে, বাসের ঘর যেমন সাজাতে হয় বাগান দিয়ে, বাসরঘর যেমন সজ্জিত হয় ফুলের মালায় । কথার শিল্প তার ছন্দে, ধ্বনির সংগীতে, বাণীর বিন্যাসে ও বাছাই-কাজে । এই খুশির বাহন অকিঞ্চিৎকর হলে চলে না, যা অত্যন্ত অনুভব করি সেটা যে অবহেলার জিনিস নয়। এই কথা প্ৰকাশ করতে হয়। কারুকাজে । অনেক সময়ে এই শিল্পকলা শিল্পিতাকে ডিঙিয়ে আপনার স্বাতন্ত্র্যকেই মুখ্য করে তোলে। কেননা, তার মধ্যেও আছে সৃষ্টির প্রেরণা। লীলায়িত অলংকৃত ভাষার মধ্যে অর্থকে ছাড়িয়েও একটা বিশিষ্ট রূপ প্ৰকাশ পায়- সে তার ধ্বনিপ্ৰধান গীতধর্মে । বিশুদ্ধ সংগীতের স্বরাজ তার আপনি ক্ষেত্রেই ভাষার সঙ্গে শরিকিয়ানা করবার তার জরুরি নেই। কিন্তু ছন্দে, শব্দবিন্যাসের ও ধ্বনিঝংকারের তির্যক ভঙ্গিতে, যে সংগীতরস প্রকাশ পায় অর্থের কাছে অগত্যা তার জবাবদিহি আছে। কিন্তু ছন্দের নেশা, ধ্বনিপ্রসাধনের নেশা, অনেক কবির মধ্যে মীেতাতি উগ্রতা পেয়ে বসে ; গদগদ আবিলতা নামে ভাষায়- ন্ত্রৈণ স্বামীর মতো তাদের কাব্য কাপুরুষতার দীের্বল্যে অশ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠে । শেষ কথা হচ্ছে ; Truth is beauty। কাব্যে এই টুথ রূপের টুথ, তথ্যের নয় । কাব্যের রূপ যদি টুথ-রূপে অত্যন্ত প্ৰতীতিযোগ্য না হয় তা হলে তথ্যের আদালতে সে অনিন্দনীয় প্রমাণিত হলেও কাব্যের দরবারে সে নিন্দিত হবে । মন ভোলাবার আসরে তার অলংকারপুঞ্জ যদি-বা অত্যন্ত গুঞ্জরিত