পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S&O রবীন্দ্র-রচনাবলী সবশেষে এই একটি কথা বলবার আছে, কাব্য প্ৰত্যহিক সংসারের অপরিমার্জিত বাস্তবতা থেকে যত দূরে ছিল এখন তা নেই। এখন সমস্তকেই সে আপন রসলোকে উত্তীর্ণ করতে চায়- এখন সে স্বৰ্গারোহণ করবার সময়েও সঙ্গের কুকুরটিকে ছাড়ে না। : বাস্তব জগৎ ও রসের জগতের সমন্বয় সাধনে গদ্য কাজে লাগবে ; কেননা গদ্য শুচিবায়ুগ্ৰস্ত নয়। SS S&S SSV)V পৌষ ১৩৪৩ গদ্যকাব্য কতকগুলি বিষয় আছে যার আবহাওয়া অত্যন্ত সূক্ষ্ম, কিছুতেই সহজে প্রতিভাত হতে চায় না। ধরা-ছোওয়ার বিষয় নিয়ে তর্কে আঘাত-প্ৰতিঘাত করা চলে । কিন্তু বিষয়বস্তু যখন অনির্বচনীয়ের কোঠায় এসে পড়ে তখন কী উপায়ে বোঝানো চলে তা হৃদ্য কি না । তাকে ভালোলাগা মন্দলাগার একটা সহজ ক্ষমতা ও বিস্তৃত অভিজ্ঞতা থাকা চাই। বিজ্ঞান আয়ত্ত করতে হলে সাধনার প্রয়োজন । কিন্তু রুচি এমন একটা জিনিস যাকে বলা যেতে পারে সাধনদুর্লভ, তাকে পাওয়ার বাধা পথ ন মেধয়া ন বহুনা শ্ৰতেন । সহজ ব্যক্তিগত রুচি-অনুযায়ী বলতে পারি যে, এই আমার ভালো লাগে । সেই রুচির সঙ্গে যোগ দেয় নিজের স্বভাব, চিন্তার অভ্যাস সমাজের পরিবেষ্টন ও শিক্ষা । এগুলি যদি ভদ্র ব্যাপক ও সূক্ষ্মবােধশক্তিমান হয় তা হলে সেই রুচিকে সাহিত্যপথের আলোক বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রুচির শুভসম্মিলন কোথাও সত্য পরিণামে পৌচেছে কি না তাও মেনে নিতে অন্য পক্ষে রুচিচর্চার সত্য আদর্শ থাকা চাই। সুতরাং রুচিগত বিচারের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা থেকে যায়। সাহিত্যক্ষেত্রে যুগে যুগে তার প্রমাণ পেয়ে আসছি। বিজ্ঞান দর্শন সম্বন্ধে যে মানুষ যথোচিত চর্চা করে নি সে বেশ নম্রভাবেই বলে, “মতের অধিকার নেই। আমার ।” সাহিত্য ও শিল্পে রসসৃষ্টির সভায় মতবিরোধের কোলাহল দেখে অবশেষে হতাশ হয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, ভিন্নরুচিহিঁ লোকঃ । সেখানে সাধনার বালাই নেই বলে স্পর্ধা আছে অবারিত, আর সেইজন্যে রুচিভেদের তর্ক নিয়ে হাতাহাতিও হয়ে থাকে। তাই বররুচির আক্ষেপ মনে পড়ে, অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম শিরসি মা লিখা মা লিখা মা লিখা। স্বয়ং কবির কাছে অধিকারীর ও অনধিকারীর প্রসঙ্গ সহজ । তার লেখা কার ভালো লাগল, কার লাগল না, শ্রেণীভেদ। এই যাচাই নিয়ে । এই কারণেই চিরকাল ধরে যাচনদারের সঙ্গে শিল্পীদের ঝগড়া চলেছে। স্বয়ং কবি কালিদাসকেও এ নিয়ে দুঃখ পেতে হয়েছে, সন্দেহ নেই ; শোনা যায় নাকি, মেঘদূতে স্কুলহস্তাবলেপের প্রতি ইঙ্গিত আছে। যে-সকল কবিতায় প্রথাগত ভাষা ও ছন্দের অনুসরণ করা হয় সেখানে অন্তত বাইরের দিক থেকে পাঠকদের চলতে ফিরতে বাধে না । কিন্তু কখনো কখনো বিশেষ কোনো রসের অনুসন্ধানে কবি অভ্যাসের পথ অতিক্রম করে থাকে। তখন অন্তত কিছুকালের জন্য পাঠকের আরামের ব্যাঘাত ঘটে বলে তারা নূতন রসের আমদানিকে অস্বীকার করে শাস্তি জ্ঞাপন করে। চলতে চলতে যে পর্যন্ত পথ চিহ্নিত হয়ে না যায় সে পর্যন্ত পথকর্তার বিরুদ্ধে পথিকদের একটা ঝগড়ার সৃষ্টি হয়ে ওঠে। সেই অশান্তির সময়টাতে কবি স্পর্ধা প্ৰকাশ করে ; বলে, “তোমাদের চেয়ে আমার মতই প্ৰমাণিক ৷” পাঠকরা বলতে থাকে, যে লোকটা জোগান দেয় তার চেয়ে যে লোক ভোগ করে তারই দাবির জোর বেশি। কিন্তু ইতিহাসে তার প্রমাণ হয় না। চিরদিনই দেখা গেছে, নূতনকে উপেক্ষা করতে করতেই নূতনের অভ্যর্থনার পথ প্রশস্ত হয়েছে। কিছুদিন থেকে আমি কোনো কোনো কবিতা গদ্যে লিখতে আরম্ভ করেছি। সাধারণের কাছ থেকে এখনই যে তা সমাদর লাভ করবে। এমন প্রত্যাশা করা অসংগত । কিন্তু সদ্য সমাদর না পাওয়াই যে তার নিস্ফলতার প্রমাণ তাও মানতে পারি। নে । এই দ্বন্দ্বের স্থলে আত্মপ্রত্যয়কে সম্মান করতে কবি