পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

३७8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এবং বায়ুপরিবর্তনের সাহায্যে শারীরিক আরোগসাধনায়। আমার বয়স যখন অল্প পিতৃদেবের সঙ্গে ভ্রমণে বের হয়েছিলেম। ঘর ছেড়ে সেই আমার প্রথম বাহিরে যাত্রা। ইটকাঠের অরণ্য থেকে অবারিত আকাশের মধ্যে বৃহৎ মুক্তি এই প্রথম আমি ভোগ করেছি। প্রথম বললে সম্পূর্ণ ঠিক বলা হয় না। এর পূর্বে কলকাতায় একবার যখন ডেঙ্গুজর সংক্রামক হয়ে উঠেছিল তখন আমার গুরুজনদের সঙ্গে আশ্রয় নিয়েছিলেম গঙ্গার ধারে লালাবাবুদের বাগানে। বসুন্ধরার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সুদূরব্যাপ্ত আস্তরণের একটি প্রান্তে সেদিন আমার বসবার আসন জুটেছিল। সমস্ত দিন বিরাটের মধ্যে মনকে ছাড়া দিয়ে আমার বিস্ময়ের এবং আনন্দের ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু তখনো আমি আমাদের পূর্বনিয়মে ছিলেম বন্দী, অবাধে বেড়ানো ছিল নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কলকাতায় ছিলেম ঢাকা খাচার পাখি, কেবল চলার স্বাধীনতা নয় চোখের স্বাধীনতাও ছিল সংকীর্ণ ; এখানে রইলুম দাড়ের পাখি, আকাশ খোলা চারি দিকে কিন্তু পায়ে শিকল । শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি। উপনয়ন-অনুষ্ঠানে ভুর্ভুবঃস্বর্লোকের মধ্যে চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করবার যে দীক্ষা পেয়েছিলেম পিতৃদেবের কাছ থেকে, এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেয়েছিলেম সেই দীক্ষাই । আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত। পিতৃদেব কোনো নিষেধ বা শাসন দিয়ে আমাকে বেষ্টন করেন নি। সকালবেলায় অল্প কিছুক্ষণ তার কাছে ইংরেজি ও সংস্কৃত পড়তেম, তার পরে আমার অবাধ ছুটি। বোলপুর শহর তখন স্ফীত হয়ে ওঠে নি। চালের কলের ধোয়া আকাশকে কলুষিত আর তার দুৰ্গন্ধ সমল করে নি মলয় বাতাসকে । মাঠের মাঝখান দিয়ে যে লাল মাটির পথ চলে গেছে তাতে লোক-চলাচল ছিল অল্পই । বাধের জল ছিল পরিপূর্ণ প্রসারিত, চার দিক থেকে পলি-পড়া চাষের জমি তাকে কোণ-ঠেসা করে আনে নি। তার পশ্চিমের উচু পাড়ির উপর অক্ষুন্ন ছিল ঘন তালগাছের শ্রেণী । যাকে আমরা খোয়াই বলি, অর্থাৎ কাকুরে জমির মধ্যে দিয়ে বর্ষার জলধারায় আঁকাবঁকা উচুনিচু খোদাই পথ, সে ছিল নানা জাতের নানা আকৃতির পাথরে পরিকীর্ণ ; কোনোটাতে শিরাকাটা পাতার ছাপ, কোনোটা লম্বা আঁশওয়ালা কাঠের টুকরোর মতো, কোনোটা স্ফটিকের দানা সাজানো, কোনোটা অগ্নিগলিত মসৃণ। মনে আছে। ১৮৭০ খৃস্টাব্দের ফরাসিপ্রশীয় যুদ্ধের পরে একজন ফরাসি সৈনিক আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল ; সে ফরাসি রান্না রোধে খাওয়াত আমার দাদাদের আর তাদের ফরাসি ভাষা শেখাত। তখন আমার দাদারা একবার বোলপুরে এসেছিলেন, সে ছিল সঙ্গে। একটা ছোটাে হাতুড়ি নিয়ে আর একটা থলি কোমরে বুলিয়ে সে এই খোয়াইয়ে দুর্লভ পাথর সন্ধান করে বেড়ােত । একদিন একটা বুড়োগোছের স্ফটিক সে পেয়েছিল, সেটাকে আংটির মতো বঁধিয়ে কলকাতায় কোন ধনীর কাছে বেচেছিল। আশি টাকায় । আমিও সমস্ত দুপুরবেলা খোয়াইয়ে প্রবেশ করে নানারকম পাথর সংগ্রহ করেছি, ধন উপার্জনের লোভে নয় পাথর উপাৰ্জন করতেই। মাঠের জল চুইয়ে সেই খোয়াইয়ের এক জায়গায় উপরের ডাঙা থেকে ছোটাে ঝরনা ঝরে পড়ত। সেখানে জন্মেছিল একটি ছোটো জলাশয়, তার সাদাটে ঘোলা জল আমার পক্ষে ডুব দিয়ে স্নান করবার মতো যথেষ্ট গভীর। সেই ডোবাটা উপচিয়ে ক্ষীণ স্বচ্ছ জলের স্রোত ঝির ঝির করে বয়ে যেত নানা শাখাপ্রশাখায়, ছোটাে ছােটাে মাছ সেই স্রোতে উজািনমুখে সীতার কাটত । আমি জলের ধার বেয়ে বেয়ে আবিষ্কার করতে বের তুম সেই শিশুভূবিভাগের নতুন নতুন বালখিল্য গিরিনদী । মাঝে মাঝে পাওয়া যেত পাড়ির গায়ে গহবর। তার মধ্যে নিজেকে প্রচ্ছন্ন করে অচেনা জিওগ্রাফির মধ্যে ভ্ৰমণকারীর গীেরব অনুভব করতুম । খোয়াইয়ের স্থানে স্থানে যেখানে মাটি জমা সেখানে বেঁটে বেঁটে বুনো জাম বুনো খেজুর, কোথাও-বা ঘন কাশ লম্বা হয়ে উঠেছে। উপরে দূরমাঠে গোরু চরছে, সাওতালরা কোথাও করছে চাষ, কোথাও চলেছে পথহীন প্রান্তরে আর্তস্বরে গোরুর গাড়ি, কিন্তু এই খোয়াইয়ের গহবরে জনপ্ৰাণী নেই। ছায়ায় রৌদ্রে বিচিত্র লাল কঁাকরের এই নিভৃত জগৎ, না দেয় ফল, না দেয় ফুল, না উৎপন্ন করে ফসল ; এখানে না আছে কোনো জীব-জন্তুর বাসা ; এখানে কেবল দেখি কোনো আর্টিস্ট-বিধাতার বিনা কারণে একখানা