পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিশ্বভারতী Sዓ¢ এ-সমস্তকেই যেন আমরা আমাদের ধ্রুব পরিচয়ের জিনিস বলে না মনে করি । এ-সমস্ত আজ আছে কাল না থাকতেও পারে । আশঙ্কা হয়। পাছে যা ছোটো তাই বড়ো হয়ে ওঠে, পাছে একদিন আগাছাই ধানের খেতকে চাপা দেয় । বনস্পতির শাখায় কোনো বিশেষ পাখি বাসা বাধতে পারে, কিন্তু সেই বিশেষ পাখির বাসাই বনস্পতির একান্ত বিশেষণ নয়। নিজের মধ্যে বনস্পতি সমস্ত অরণ্যপ্রকৃতির যে সত্যপরিচয় দেয় সেইটেই তার বড়ো লক্ষণ । পূর্বেই বলেছি, ভারতের যে প্রকাশ বিশ্বের শ্ৰদ্ধেয় সেই প্রকাশের দ্বারা বিশ্বকে অভ্যর্থনা করব, এই হচ্ছে আমাদের সাধনা । বিশ্বভারতীর এই কাজে পশ্চিম-মহাদেশে আমি কী অভিজ্ঞতা লাভ করেছি সে কথা বলতে আমি কুষ্ঠিত হই। দেশের লোকে অনেকে হয়তো সেটা শ্রদ্ধাপূর্বক গ্ৰহণ করবেন না, এমন-কি, পরিহাসরসিকেরা বিদ্রুপও করতে পারেন । কিন্তু সেটাও কঠিন কথা নয়। আসলে ভাবনার কথাটা হচ্ছে এই যে, বিদেশে আমাদের দেশ যে শ্রদ্ধা লাভ করে, পাছে সেটাকে কেবলমাত্র অহংকারের সামগ্ৰী করে তোলা হয় । সেটা আনন্দের বিষয়, সেটা অহংকারের বিষয় নয় । যখন অহংকার করি তখন বাইরের লোকদের আরো বাইরে ফেলি, যখন আনন্দ করি তখনই তাদের নিকটের বলে জানি । বারংবার এটা দেখেছি, বিদেশের যে-সব মহদাশয় লোক আমাদের ভালোবেসেছেন, আমাদের অনেকে তাদের বিষয়সম্পত্তির মতো গণ্য করেছেন । তারা আমাদের জাতিকে যে আদর করতে পেরেছেন সেটুকু আমরা ষোলো-আনা গ্ৰহণ করেছি, কিন্তু আমাদের তরফে তার দায়িত্ব স্বীকার করি নি । তাদের ব্যবহারে তাদের জাতির যে গৌরব প্ৰকাশ হয় সেটা স্বীকার করতে অক্ষম হয়ে আমরা নিজের গভীর দৈন্যের প্রমাণ দিয়েছি । তাদের প্রশংসাবাক্যে আমরা নিজেদের মহৎ বলে স্পর্ধিত হয়ে উঠি ; এই শিক্ষাটুকু একেবারেই ভুলে যাই যে, পরের মধ্যে যেখানে শ্রেষ্ঠতা আছে সেটাকে অকুষ্ঠিত আনন্দে স্বীকার করা ও প্রকাশ করার মধ্যে মহত্ত্ব আছে । আমাকে এইটোতেই সকলের চেয়ে নম্র করেছে যে, ভারতের যে পরিচয় অন্য দেশে আমি বহন করে নিয়ে গেছি কোথাও তা অবমানিত হয় নি । আমাকে যারা সম্মান করেছেন তারা আমাকে উপলক্ষ করে ভারতবর্ষকেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন । যখন আমি পৃথিবীতে না থাকব। তখনো যেন তার ক্ষয় না ঘটে, কেননা এ সম্মান ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে যুক্ত নয় । বিশ্বভারতীকে গ্রহণ করে ভারতের অমৃতরূপকে প্রকাশের ভার আপনারা গ্ৰহণ করেছেন। আপনাদের চেষ্টা সার্থক হােক, অতিথিশালা দিনে দিনে পূর্ণ হয়ে উঠুক, অভ্যাগতরা সম্মান পান, আনন্দ পান, হৃদয় দান করুন, হৃদয় গ্ৰহণ করুন, সত্যের ও প্রীতির আদানপ্রদানের দ্বারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারতের যোগ গভীর ও দূরপ্রসারিত হােক, এই আমার কামনা। ৯ই পৌষ ১৩৩২ ୪P୍ମ >ଏଠକ୍ শান্তিনিকেতন SV) বাংলাদেশের পল্লীগ্রামে যখন ছিলাম, সেখানে এক সন্ন্যাসিনী আমাকে শ্রদ্ধা করতেন । তিনি কুটিরনির্মাণের জন্য আমার কাছে ভূমি ভিক্ষা নিয়েছিলেন- সেই ভূমি থেকে যে ফসল উৎপন্ন হত তাই দিয়ে তার আহার চলত, এবং দুই-চারিটি অনাথ শিশুদের পালন করতেন। তার মাতা ছিলেন সংসারে- তার মাতার অবস্থাও ছিল সচ্ছল- কন্যাকে ঘরে ফিরিয়ে নেবার জন্যে তিনি অনেক চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কন্যা সম্মত হন নি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, নিজের ঘরে অন্নে আত্মাভিমান জন্মে— মন থেকে এই ভ্ৰম কিছুতে ঘুচিতে চায় না যে, এই অল্পের মালেক আমিই, আমাকে আমিই খাওয়াচ্ছি। কিন্তু দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে যে অন্ন পাই সে অন্ন ভগবানের- তিনি সকল মানুষের হাত দিয়ে সেই অন্ন আমাকে দেন, তার উপরে আমার নিজের দাবি নেই, তার দয়ার উপর ভরসা।