পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V ধর্মবুদ্ধি চরিত্রবল যখন জাগিয়া উঠে তখন সে এইসকল বিড়ম্বনা-সৃষ্টিকে প্রবল পীেরুষের সহিত অবজ্ঞা করে। মানুষের যে-সকল দুঃখ-দুৰ্গতি সম্মুখে স্পষ্ট বিদ্যমান তাহাকে সে হৃদয়হীন ভাবুকতার সূক্ষ্ম কারুকার্যে মনােরম করিয়া তোলার অধ্যবসায়কে কিছুতেই আর সহ্য করিতে পারে না। ইহা হইতেই আমাদের প্রয়োজন বুঝা যাইবে । জ্ঞানবৃদ্ধির দ্বারা আমাদের সম্পূর্ণ বলবৃদ্ধি হইতেছে না। আমাদের মনুষ্যত্বকে সমগ্রভাবে উদবোধিত করিয়া তোলার অভাবে আমরা নিভীক পৌরুষের সহিত পূর্ণশক্তিতে জীবনকে মঙ্গলের সরল পথে প্রবাহিত করিতে পারিতেছি না। এই দুৰ্গতির দিনে সেই মহাপুরুষেরাই আমাদের সহায় যাহারা কোনো কারণেই কোনো প্রলোভনেই আপনাকে এবং অন্যকে বঞ্চনা করিতে চান নাই, র্যাহারা প্ৰবল বলে মিথ্যাকে অস্বীকার করিয়াছেন এবং সমস্ত পৃথিবীর লোকের নিকট অপমানিত হইয়াও সত্যকে যাহারা নিজের জীবন দিয়া সপ্রমাণ করিয়াছেন। তঁহাদের চরিত চিন্তা করিয়া সমস্ত কৃত্রিমতা কুটিলতর্ক ও প্রাণহীন বাহ্য-আচারের জটিল বেষ্টন হইতে চিত্ত মুক্তিলাভ করিয়া রক্ষা পায় । যিশুর চরিত আলোচনা করিলে দেখিতে পাইব র্যাহারা মহাত্মা তাহারা সত্যকে অত্যন্ত সরল করিয়া । সমস্ত জীবনের সামগ্ৰী করিয়া দেখেন— তাহারা কোনাে নূতন পন্থা, কোনাে বাহ্য প্রণালী, কোনাে অদ্ভুত মত প্রচার করেন না। তাহারা অত্যন্ত সহজ কথা বলিবার জন্য আসেন— তাহারা পিতাকে পিতা বলিতে ও ভাইকে ভাই ডাকিতে জন্মগ্রহণ করেন । তাহারা এই অত্যন্ত সরল বাক্যটি অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলিয়া যান যে, যাহা অন্তরের সামগ্ৰী তাহাকে বাহিরের আয়োজনে পুঞ্জীকৃত করিবার চেষ্টা করা বিড়ম্বনা মাত্র। তাহারা মনকে জাগাইতে বলেন, তাহারা দৃষ্টিকে সরল করিয়া সম্মুখে লক্ষ করিতে বলেন, অন্ধ অভ্যাসকে তাহারা সত্যের সিংহাসন হইতে অপসারিত করিতে আদেশ করেন । র্তাহারা কোনো অপরূপ সামগ্ৰী সংগ্ৰহ করিয়া আনেন না, কেবল তঁহাদের দীপ্ত নেত্রের দৃষ্টিপাতে আমাদের জীবনের মধ্যে র্তাহারা সেই চিরকালের আলোক নিক্ষেপ করেন যাহার আঘাতে আমাদের দুর্বল জড়তার সমস্ত ব্যর্থ জাল-বুনানির মধ্য হইতে আমরা লজ্জিত হইয়া জাগিয়া উঠি । জাগিয়া উঠিয়া আমরা কী দেখি ? আমরা মানুষকে দেখিতে পাই। আমরা নিজের সত্যমূর্তি সম্মুখে দেখি। মানুষ যে কত বড়ো সে কথা আমরা প্রতিদিন ভুলিয়া থাকি ; স্বরচিত ও সমাজরিচিত শত শত বাধা আমাদিগকে চারি দিক হইতে ছোটো করিয়া রাখিয়াছে, আমরা আমাদের সমস্তটা দেখিতে পাই না। যাহারা আপনার দেবতাকে ক্ষুদ্র করেন নাই, পূজাকে কৃত্রিম করেন নাই, লোকাচারের দাসত্বচিহ্ন ধুলায় ফেলিয়া দিয়া যাহারা আপনাকে অমতের পুত্র বলিয়া সগৌরবে ঘোষণা করিয়াছেন, তাহারা মানুষের কাছে মানুষকে বড়ো করিয়া দিয়াছেন । ইহাকেই বলে মুক্তি দেওয়া । মুক্তি স্বৰ্গ নহে, সুখ নহে। মুক্তি অধিকারবিস্তার, মুক্তি ভূমাকে উপলব্ধি। সেই মুক্তির আহবান বহন করিয়া নিত্যকালের রাজপথে ঐ দেখো কে আসিয়া দাড়াইয়াছেন। তীহাকে অনাদর করিয়ো না, আঘাত করিয়ো না, “তুমি আমাদের কেহ নও" বলিয়া আপনাকে হীন করিয়ো না । ‘তুমি আমাদের জাতির নও’ বলিয়া আপনার জাতিকে লজ্জা দিয়ে না। সমস্ত জড়াসংস্কারজাল ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আইস, ভক্তিনম্র চিত্তে প্ৰণাম করো, বলে- “তুমি আমাদের অত্যন্ত আপন, কারণ, তোমার মধ্যে আমরা আপনাকে সত্যভাবে লাভ করিতেছি।” যে সময়ে কোনো দেশে কোনো মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন সে সময়কে আমরা তাহার আবির্ভাবের অনুকূল সময় বলিয়া গণ্য করি। এ কথা এক দিক হইতে সত্য হইলেও, এ সম্বন্ধে আমাদের ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা আছে। সাধারণত যে লক্ষণগুলিকে আমরা অনুকুল বলিয়া মনে করি তাহার বিপরীতকেই প্রতিকুল বলিয়া গণ্য করা চলে না। অভাব অত্যন্ত কঠোর হইলে মানুষের লাভের চেষ্টা অত্যন্ত জাগ্রত হয়। অতএব একান্ত অভাবকেই লাভসম্ভাৱনার প্রতিকুল বলা যাইতে পারে না। বাতাস যখন অত্যন্ত স্থির হয় তখনই ঝড়কে আমরা আসন্ন বলিয়া থাকি । বস্তুত মানুষের ইতিহাসে আমরা বরাবর দেখিয়া আসিতেছি- প্রতিকূলতা যেমন আনুকূল্য করে এমন আর কিছুতেই নহে। যিশুর জন্মগ্রহণকালের প্রতি লক্ষ করিলেও আমরা এই সত্যটির প্রমাণ পাইব ।