পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

- ovv রবীন্দ্র-রচনাবলী একটা অবসাদ এসে আমাদের শক্তিকে ভুলিয়ে দিয়েছে। এককালে আমরা অনেক কর্ম করেছি, অনেক কীর্তি রেখেছি, সে কথা ইতিহাস জানে। তার পর কখন অন্ধকার ঘনিয়ে এল ভারতবাসীর চিত্তে, আমাদের দেহে মনে অসাড়তা এনে দিলে। মনুষ্যত্বের গীেরব যে আমাদের অন্তর্নিহিত, সেটাকে রক্ষা করবার জন্যে যে আমাদের প্রাণপণ করতে হবে, সে আমাদের মনে রইল না। একেই বলে মোহ। এই মোহে আমরা নিজের মরার পথ বাধামুক্ত করেছি, তার পর যাদের আত্মম্ভরিতা প্রবল, আমাদের মার আসছে তাদেরই হাত দিয়ে । আজ বলতে এসেছি, আত্মাকে অবমানিত করে। রাখা আর চলবে না । আমরা বলতে এসেছি যে, আজ আমরা নিজের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করলেম । একদিন সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেম, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস রক্ষা করেছিলেম। তখন জলাশয়ে জল ছিল, মাঠে শস্য ছিল, তখন পুরুষকার ছিল মনে। এখন সমস্ত দূর হয়েছে। আবার একবার নিজেকে নিজের দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে । কোনো উপায় নেই। এত বড়ো মিথ্যা কথা যেন না বলি। বাহির থেকে দেখলে তো দেখা যায় কিছু পরিমাণেও বেঁচে আছি। কিছু আগুনও যদি ছাই-চাপা পড়ে থাকে তাকে জাগিয়ে তোলা যায়। এ কথা যদি নিশ্চেষ্ট হয়ে স্বীকার না করি, তবে বুঝব এটাই মোহ। অর্থাৎ, যা নয়। তাই মনে করে বসা । একটা ঘটনা শুনেছি- হাঁটুজলে মানুষ ডুবে মরেছে ভয়ে । আচমকা সে মনে করেছিল পায়ের তলায় মাটি নেই। আমাদেরও সেইরকম। মিথ্যে ভয় দূর করতে হবে, যেমনি হােক পায়ের তলায় খাড়া দাড়াবার জমি আছে। এই বিশ্বাস দৃঢ় করব, সেই আমাদের ব্ৰত। এখানে এসেছি সেই ব্ৰতের কথা ঘোষণা করতে। বাইরে থেকে উপকার করতে নয়, দয়া দেখিয়ে কিছু দান করবার জন্যে নয়। যে প্রাণস্রোত তার আপনার পুরাতন খাত ফেলে দূরে সরে গেছে, বাধামুক্ত করে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে । এসো, একত্রে কাজ করি । সং বাে। মনাংসি সংব্ৰতা সমীকৃতীৰ্ণমামসি । অমী যে বিব্রতা স্থান তান বঃ সং নময়ামসি । এই ঐক্য যাতে স্থাপিত হয়, তারই জন্যে অক্লান্ত চেষ্টা চাই। ঘরে ঘরে কত বিরোধ। বিচ্ছিন্নতার রন্ধে রন্ধে আমদের ঐশ্বর্যকে আমরা ধূলি-স্থলিত করে দিয়েছি। সর্বনেশে ছিদ্রগুলোকে রোধ করতে হবে আপনার সাব-কিছু দিয়ে । আমরা পরবাসী । দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না । যতক্ষণ দেশকে না জানি, যতক্ষণ তাকে নিজের শক্তিতে জয় না করি, ততক্ষণ সে দেশ আপনার নয় । আমরা এই দেশকে আপনি জয় করি নি। দেশে অনেক জড় পদার্থ আছে, আমরা তাদেরই প্ৰতিবেশী । দেশ যেমন এই সব বস্তুপিণ্ডের নয়, দেশ তেমনি আমাদেরও নয়। এই জড়ত্ব- একেই বলে মোহ । যে মোহাভিভূত সেই তো চিরপ্রবাসী । সে জানে না সে কোথায় আছে। সে জানে না তার সত্যসম্বন্ধ কার সঙ্গে । বাইরের সহায়তার দ্বারা নিজের সত্য বস্তু কখনোই পাওয়া যায় না । আমার দেশ আর কেউ আমাকে দিতে পারবে না । নিজের সমস্ত ধন-মন-প্ৰাণ দিয়ে দেশকে যখনই আপনি বলে জানতে পারব তখনই দেশ আমার স্বদেশ হবে । পরবাসী স্বদেশে যে ফিরেছি। তার লক্ষণ এই যে, দেশের প্রাণকে নিজের প্রাণ বলেই জানি । পাশেই প্ৰত্যক্ষ মরছে দেশের লোক রোগে উপবাসে, আর আমি পরের উপর সমস্ত দোষ চাপিয়ে মঞ্চের উপর চড়ে দেশাত্মবোধের বাগবিস্তার করছি, এত বড়ো অবাস্তব অপদার্থতা আর কিছু হতেই পারে না। রোগপীড়িত এই বৎসরে এই সভায় আজ আমরা বিশেষ করে এই ঘোষণা করছি যে, গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে হবে, অবিরোধে একত্ৰত সাধনার দ্বারা । রোগজীর্ণ শরীর কর্তব্য পালন করতে পারে না। এই ব্যাধি যেমন দারিদ্র্যের বাহন, তেমনি আবার দারিদ্র্যও ব্যাধিকে পালন করে। আজ নিকটবতী বারোটি গ্রাম একত্র করে রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। এই কাজে গ্রামবাসীর সচেষ্ট'মন চাই। তারা যেন সবলে বলতে পারে, “আমরা পারি, রোগ দূর আমাদের অসাধ্য নয়।' যাদের মনের তেজ আছে তারা দুঃসাধ্য রোগকে নিৰ্মল করতে পেরেছে, ইতিহাসে তা দেখা গেল।