পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিবিধ প্ৰসঙ্গ ○ゲ○ বুদ্ধির যথেষ্ট লক্ষণ প্রকাশ করিলেও তাঁহাদের দুর্নােম ঘুচে না। নহিলে “বান্দর” বলিয়া সম্ভাষণ করিলে লোকে কেন মনে করে, তাহাকে নির্বোিধ বলা হইল ? পশুদের মধ্যে বানরের বুদ্ধির অভাব বিশেষ লক্ষিত হয় নাই, তাহার একমাত্র অপরাধ সে বেচারী উদ্ভিদভোজী । অতএব অনৰ্থক এমন একটা দুর্নামভাজন হইয়া থাকিবার আবশ্যক কি ? আর একটা কথা— উদ্ভিদভোজী ভারতবর্ষকে ইংরাজ-শ্বাপদেরা দিব্য হজম করিতে পারিয়াছেন ; কিন্তু পাকযন্ত্রের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থাকাতে মাংসাশী কান্দাহার গ্ৰাস করিলেন, ভালো হজম হইল না ; পেটের মধ্যে বিষম গোলযোগ বাধাইয়া দিল। মাংসাশী জুলুভূমি ও ট্রান্সবাল পেটে মূলেই সহিল না, আহার করিতে চেষ্টা করিতে গিয়া মাঝের হইতে বলহানি হইল, রোগ হইবার উপক্রম হইল। অতএব মাংসাশী প্রাণীর লোভ এড়াইতে যদি ইচ্ছা! থাকে, তবে মাংসাশী হওয়া আবশ্যক । নহিলে আত্মত্ব বিসর্জন করিয়া পরের দেহের রক্ত নির্মাণ করাই আমাদের চরম সিদ্ধি হইবে । মাংস খাইবার এক আপত্তি আছে যে, শাস্ত্ৰে মাংসকে অপবিত্র বলে । কিন্তু সে কোনো কাজের কথাই নহে। শাস্ত্রেই আছে, মেদিনী মাংসেই নির্মিত । আমরা মাংসের উপরেই বাস করি। এ মাংসের পৃথিবীতে মাংসেরই জয় । অনধিকার পূর্বকালে মহারাজ জনকের রাজ্যে এক ব্ৰাহ্মণ কোনো গুরুতর অপরাধ করাতে জনকরাজ তাহাকে শাসন করিবার নিমিত্ত কহিয়াছিলেন, “হে ব্ৰাহ্মণ, আপনি আমার অধিকার-মধ্যে বাস করিতে পরিবেন। না।” মহাত্মা জনক এইরূপ আজ্ঞা করিলে ব্ৰাহ্মণ র্তাহাকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “মহারাজ, কোন কোন স্থানে আপনার অধিকার আছে আপনি তাহা নির্দেশ করুন ; আমি অবিলম্বেই আপনার ব্যাক্যানুসারে সেই সমূদয় স্থান পরিত্যাগ করিয়া অন্য রাজার রাজ্যে গমন করিব।” ব্ৰাহ্মণ এই কথা কহিলে, মহারাজ জনক তাহা শ্রবণ করিয়া দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ-পূর্বক মীেনভাবে চিন্তা করিতে করিতে অকস্মাৎ রাহুগ্ৰস্ত দিবাকরের ন্যায় মহামোহে সমাক্রান্ত হইলেন । কিয়ৎক্ষণ পরে তাহার মোহ অপনীত হইলে ব্ৰাহ্মণকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “ভগবন, যদিও এই পুরুষপরম্পরাগত রাজ্য আমার বশীভূত রহিয়াছে, তথাপি আমি বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, পৃথিবীন্থ কোনাে পদার্থেই আমার সম্পূর্ণ অধিকার নাই। আমি প্রথমে সমূদয় পৃথিবীতে, তৎপরে একমাত্র মিথিলানগরীতে, ও পরিশেষে স্বীয় ་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་་ আপনার অধিকার অন্বেষণ করিলাম, কিন্তু কোনাে পদার্থের আমার সম্পূর্ণ স্বত্ব ३श्न का।" -কালীসিংহের অনুবাদিত মহাভারত । আশ্বমেধিক পৰ্ব্ব । অনুগীতা পৰ্যাধ্যায়। দ্বাত্রিংশত্তম অধ্যায়। পৃ৪২ জনক রাজার উক্তির তাৎপর্য এই যে, যাহা কিছুকে আমরা আমার বলি তাহার কিছুই আমার নয়। আমার সহিত তাঁহাদের নুনাধিক সম্বন্ধ আছে। এই পর্যন্ত, কিন্তু তাঁহাদের প্রতি আমার কিছু মাত্র অধিকার নাই। আমরা ষষ্ঠীকে যে সম্বন্ধ-কারক বলি তাহা অতি যথার্থ, কিন্তু ইংরাজেরা যে তাহাকে Possessive Case বলে তাহা অতি ভুল। মানুষের ব্যাকরণে সম্বন্ধ-কারক আছে কিন্তু Possessive case নাই। একটি পরমাণুও আমরা সম্পূর্ণ ভোগ করিতে পারি না, সম্পূর্ণ জানিতে পারি না, ধ্বংস করিতে পারি না, নিয়মিত কালের অধিক রাখিতে পারি না । এমনকি, আমাদের শরীর ও মনের সহিত আমাদের সম্বন্ধ আছে বটে, কিন্তু তাহদের উপর আমাদের অধিকার নাই। আমরা নিতান্ত দরিদ্র, একটি ধনীর প্রাসাদে বাস করিতেছি। তিনি আমাদিগকে র্তাহার কতকগুলি গৃহসজ্জা ব্যবহার করিতে দিয়াছেন মাত্র । একটি মন দিয়াছেন, একটি শরীর দিয়াছেন, আরো কতকগুলি ব্যবহার্য পদার্থ