পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

やぬbr রবীন্দ্র-রচনাবলী তখন ইচ্ছার পায়ের শব্দ পাইলেই ভাবেরা কে কোথায় পলাইয়া যায় তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না ও সমস্ত দিনের পর শ্ৰান্ত ইচ্ছা তাহার বড়ো বড়ো কামান বন্দুক ফেলিয়া কপালের ঘর্মজল মুছিতে থাকে, অথচ কোথা-হইতে-কি-একটা সামান্য বিষয় সহসা ভাসিয়া বিনা আয়াসে এক মুহুর্তের মধ্যে শত সহস্র জীবন্ত ভাব আনিয়া উপস্থিত করে ও ইচ্ছার পশ্চাতে করতালি দিতে থাকে। কবিদের জিজ্ঞাসা কর, তাহদের কত বড়ো বড়ো ভাব দৈবাৎ কথার মিল করিতে গিয়া মনে পড়িয়ছে, ইচ্ছা করিলে মনে পড়িত না। মানুষের অনেক বড়ো বড়ো আবিক্রিয়ার মূল অসুসন্ধান করিতে যাও, দেখিবে- একটা সামান্য একরাত্তি ব্যাপার । ክኔ'ዞ‛ দেখা যাইতেছে আমাদের ইচ্ছা বলিয়া একটা বিষম দাম্ভিক ব্যক্তিকে আমাদের মন-গায়ে অতি অল্প লোকেই মানিয়া থাকে, অথচ সে এক জন আপনি-মোড়ল । ছোটাে ছোটাে কতকগুলি সামান্য বিষয়ের উপর তাহার আধিপত্য, অথচ সকলকেই তিনি আদেশ করিয়া বেড়ান। একটা কাজ সমাধা হইলে তিনি জাক করিয়া বেড়ান। 'এ কাজের কল আমি টিপিয়া দিয়াছিলাম”। অথচ কত ক্ষুদ্রতম তুচ্ছতম বিষয় তাহার নিজের কল টিপিয়া দিয়াছে তাহার খবর রাখেন না। তাহার দৃষ্টি সম্মুখে, তিনি দেখিতেছেন দুচ্ছেদ্য লীেহের লাগাম দিয়া সমস্ত কাজকে তিনি চালাইয়া বেড়াইতেছেন, পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখেন না। তাহাকে কে মাকড়ষার জলের চেয়ে সূক্ষ্মতর তুচ্ছতর সহস্ৰ সূত্রে বাধিয়া নিয়মিত করিতেছে! মনে করিতে কষ্ট হয়- কত অল্প বিষয়ই আমাদের ইচ্ছার অধীন ও কত সহস্ৰ ক্ষুদ্র বিষয়ের অধীন আমাদের ইচ্ছা! অভিনয় এই জন্যই বহুকাল হইতে লোকে বলিয়া আসিতেছে- আমরা অদৃষ্ট্রের খেলেন । আমাদের লইয়া সে খেলা করিতেছে। সুখের বিষয় এই যে, নিতান্ত ছেলেখেলা নয়। একটা নিয়ম আছে, একটা ফল আছে। অভিনয়ের সঙ্গে মনুষ্যজীবনের তুলনা পুরানো হইয়া গিয়াছে, কিন্তু কেবল মাত্র সেই অপরাধে সে তুলনাকে যাবজীবন নির্বাসিত করা যায় না। অভিনয়ের সঙ্গে মনুষ্যজীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়। প্রত্যেক অভিনেতার অভিনয় আলাদা আলাদা করিয়া দেখিলে সকলি ছাড়া-ছাড়া বিশৃঙ্খল বলিয়া মনে হয়, একটা অর্থ পাওয়া যায় না । তেমনি প্রত্যেক মনুষ্যের জীবনলীলা সাধারণ মনুষ্যজীবন হইতে পৃথক করিয়া দেখিলে নিতান্ত অর্থশূন্য বলিয়া বােধ হয়, অদৃষ্ট্রের ছেলেখেলা বলিয়া মনে হয় । কিন্তু তাহা নহে ; আমরা একটা মহানাটক অভিনয় করিতেছি, প্রত্যেকের অভিনয়ে তাহার উপাখ্যানভাগ পরিপুষ্ট হইতেছে। এক এক জন অভিনেতা রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিতেছে, নিজের নিজের পালা অভিনয় করিতেছে ও নিষ্ক্রান্ত হইয়া যাইতেছে, সে জানে না। তাহার ঐ জীবনাংশের অভিনয়ে সমস্ত নাটকের উপাখ্যানভাগ কিরূপে সৃজিত হইতেছে। সে নিজের অংশটুকু জানে মাত্ৰ ; সমস্তটার সহিত যোগটুকু জানে না। কাজেই সে মনে করিল, “আমার পালা সাঙ্গ হইল এবং সমস্তই সাঙ্গ হইল।” প্রত্যহ সে শত সহস্ৰ অভিনেতা, সামান্যই হউক আর মহৎই হউক, রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করিতেছে ও নিষ্ক্রান্ত হইতেছে, সকলেই সেই মহা-উপাখ্যানের সহিত জড়িত, কেহ অধিক, কেহ অল্প ; কেহ বা নিজের অভিনয়াংশের সহিত সাধারণ উপাখ্যানের যোগ কিয়ৎপরিমাণে জানে, কেহ বা একেবারেই জানে না। মনে কর, এই মহানাটকের “ফরাসীবিপ্লবী”-নামক একটা গর্ভাঙ্ক অভিনয় হইয়া গেল, কত শত বৎসর ধরিয়া কত শত রাজা হইতে কত শত দীনতম ব্যক্তি না জানিয়া না শুনিয়া ইহার অভিনয় করিয়া আসিতেছে ; তাহাদের প্রত্যেকের জীবন পৃথক করিয়া পড়িলে এক একটি প্ৰলাপ বলিয়া বোধ হয়, কিন্তু সমস্তটা একত্র করিয়া পড়বার ক্ষমতা থাকিলে প্ৰকাণ্ড একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ নাটক পড়া যায়।