পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ԳՏ) নীহাররঞ্জনের বিদ্যের দৌড় কতদূর । শুনেছি ও ঘরে বসে বসে। ফরাসী পড়ার চর্চা করে।” নীহাররঞ্জনের বাড়ি চন্দননগরে। প্রথম বয়সে ফরাসী স্কুলে তার বিদ্যাশিক্ষা, সেখানে ওর ভাষার দখল নিয়ে খুব খ্যাতি পেয়েছিল, এ-সব কথা ওর কলকাতার বন্ধু-মহল কেউ জানত না । যা হােক, সে তো কোমর বেঁধে দাঁড়ালো। কী আশ্চর্য অভিনন্দন যখন পড়ল তার ভাষার ছটায় ফরাসী পণ্ডিত এবং তার দু-একজন অনুচর আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তঁরা বললেন- এরকম মার্জিত ভাষা ফ্রান্সের বাইরে কখনো শোনেন নি। বললেন, এ ছেলেটির উচিত প্যারিসে গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে আসা। তার পর থেকে ওদের কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলীতে ধন্য ধন্য রব উঠল ; বললে- কলেজের নাম রক্ষা হল, এমন-কি, কলকাতা ইউনিভারসিটিকেও ছাড়িয়ে গেল খ্যাতিতে । এর পরে নীহারকে অবজ্ঞা করা কারও সাধ্যের মধ্যে রইল না । নীহারদা' নীহারদা' গুঞ্জনধ্বনিতে কলেজ মুখরিত হয়ে উঠল। প্ৰগতিসংঘের প্রথম নিয়মটা আর টেকে না । পুরুষদের মন ভোলাবার জন্য রঙিন কাপড়-চোপড় পরা ওরা ত্যাগ করেছিল । সাব-প্রথমে সে নিয়মটি ভাঙল সুব্রীতি, রঙ লাগালো তার আঁচলায় । আগেকার বিরুদ্ধ ভােব কাটিয়ে নীহাররঞ্জনের কাছে ঘেঁষতে তার সংকোচ বোধ হতে লাগল, কিন্তু সে সংকোচ বুঝি টেকে না । দেখলে অন্য মেয়েরা সব তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে । কেউ-বা ওকে চায়ে নিমন্ত্রণ করছে, কেউ-বা বাধানো টেনিসন এক সেট লুকিয়ে ওর ডেস্কের মধ্যে উপহার রেখে যাচ্ছে। কিন্তু সুরীতি পড়ছে পিছিয়ে। একজন মেয়ে নীহারকে যখন নিজের হাতের কাজ-করা সুন্দর একটি টেবিল-ঢাকা দিলে, তখন সুব্রীতির প্রথম মনে বিধল, ভাবল, “আমি যদি এই সব মেয়েলি শিল্পকার্যের চর্চা করতাম।” সে যে কোনোদিন সূচের মুখে সুতো পরায় নি, কেবল বই পড়েছে। সেই তার পাণ্ডিত্যের অহংকার আজ তার কাছে খাটাে হয়ে যেতে লাগল। "কিছু-একটা করতে পারতুম যেটাতে নীহারের চোখ ভুলতে পারত— সে আর হয় না। অন্য মেয়েরা তাকে নিয়ে কত সহজে সামাজিকতা করে। সূরীতির খুব ইচ্ছে সেও তার মধ্যে ভরতি হতে পারত যদি, কিন্তু কিছুতেই খাপ খায় না। তার ফল হল এই— তাঁর আত্মনিবেদন অন্য মেয়েদের চেয়েও আরো যেন জোর পেয়ে উঠল । সে নীহারের জন্য কোনো অছিলায় নিজের কোনো একটা ক্ষতি করতে পারলে কৃতাৰ্থ হত । একেবারে প্রগতিসংঘের পালের হাওয়া বদলে গেল । অন্য মেয়েরা ক্রমে নিয়মিতভাবে তাদের পড়াশুনায় লেগে গেল, কিন্তু সূরীতি তা পেরে উঠল না। একদিন ডেস্কের উপর থেকে দৈবাৎ নীহারের ফাউনটেনপেনটি মেঝের উপর গড়িয়ে পড়েছিল, সর্বাগ্রে সেটা সে তুলে ওকে দিলে। এর চেয়ে অবনতি সূরীতির আর কোনোদিন হয় নি। একদিন নীহার বক্তৃতায় বলেছিল— তার মধ্যে ফরাসী নাট্যকারের কোটেশন ছিল— ‘সব সুন্দর জিনিসের একটা অবগুণ্ঠন আছে, তার উপরে পরুষদৃষ্টির হওয়া লাগলে তার সীেকুমাৰ্যনিষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে মেয়েরা যে পারতপক্ষে পুরুষদের কাছে দেখা দিত না, তার প্রধান কারণ এই যে, দেখা দেওয়ার দ্বারা মেয়েদের মূল্য কমে যায়। তাদের কমনীয়তার উপরে দাগ পড়তে থাকে । অন্য মেয়েরা এই কথা নিয়ে বিরুদ্ধ তর্কে উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা বললে, এমনতরো করে ঢেকেঢুকে কমনীয়তা রক্ষা করবার চেষ্টা করা অত্যন্ত বিড়ম্বনা। সংসারে পরুষষ্পর্শ কী স্ত্রী, কী পুরুষ, সকলেরই পক্ষে সমান আবশ্যক। আশ্চর্য এই, আর কেউ নয়, স্বয়ং সুগ্ৰীতি উঠে নীহারের কথার সমর্থন করলে। এই এক সর্বনের ধাক্কায় তার চালচলন সম্পূর্ণ বদলে যাবার জো হল। এখন সে পরামর্শনিতে যায় নীহারের কাছে। যখন শেক্সপীয়রের নাটক সিনেমাতে দেখানাে হয়, তখন তাও কি মেয়েরা কােনাে পুরুষ অভিভাবকের সঙ্গে গিয়ে দেখে আসতে পারে না। নীহার কড়া হুকুম জারি করলে— তাও না। কোনোক্রমে নিয়মের ব্যতিক্রম হলে নিয়ম আর রক্ষা করা যায় না। প্ৰত্যেকবারেই সূরীতি ভালো কিছু দেখবার থাকলে সিনেমাতে যেত। এখন তার কী হ’ল ! এত সািহত্যাগ তো কল্পনা করা যায় না, এমনকি, আজকািলকার দিনে যে সামাজিক নিমন্ত্রণে পুরুষের একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলত, সেখানে সে যাওয়া ছেড়ে দিলে। সনাতনীরা খুব তার à8 ||V