পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brS রবীন্দ্র-রচনাবলী নেত্ৰে শৈলের পথে পথে ভ্ৰমণ করিতেছে। তুষারে পদতল প্রস্তরের ন্যায় অসাড় হইয়া গিয়াছে, শীতে সমস্ত শরীর কঁাপিতেছে, মুখ নীলবৰ্ণ পার্শ্ব দিয়া দুই একটি নীরব পান্থ চলিয়া যাইতেছে। হতভাগিনী কমল করুণনেত্রে এক-একবার তাহাদের মুখের দিকে চাহিতেছে। কী বলিতে গিয়া বলিতেছে না, আবার অশ্রুসলিলে অঞ্চল সিক্ত করিয়া তুষারস্তরে পদচিহ্ন অঙ্কিত করিতেছে। কুটিরে রুগণ মাতা অনাহারে শয্যাগত। সমস্তদিন বালিকা এক মুষ্টিও আহার করিতে পায় নাই, প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথে পথে ভ্ৰমণ করিতেছে। সাহস করিয়া ভীতিবিহ্বল বালা কাহারও কাছে ভিক্ষা চাহিতে পারে নাই- বালিকা কখনো ভিক্ষা করে নাই, কী করিয়া ভিক্ষা করিতে হয় জানে না, কাহাকে কী বলিতে হয় জানে না। আলুলিত কুন্তলরাশির মধ্যে সেই ক্ষুদ্র করুণ মুখখানি দেখিলে, দারুণ শীতে কম্পমান তাহার সেই ক্ষুদ্ৰ দেহখানি দেখিলে, পাষাণও বিগলিত হইত। ক্ৰমে অন্ধকার ঘনীভূত হইল। নিরাশ বালিকা ভগ্নহৃদয়ে শূন্য অঞ্চলে কুটিরে ফিরিয়া যাইতেছেকিন্তু অসাড় পা আর উঠে না ; অনাহারে দুর্বল, পথশ্রমে ক্লান্ত, নিরাশায় ত্ৰিয়মাণ, শীতে অবসন্ন বালিকা আর চলিতে পারে না, অবশ হইয়া পথপ্রান্তে তুষারশয্যায় শুইয়া পড়িল। শরীর ক্ৰমে আরো অবসন্ন হইতে লাগিল। বালিকা বুঝিল ক্ৰমে সে অবসন্ন হইয়া তুষারে চাপা পড়িয়া মরিবে । মাকে স্মরণ করিয়া কাদিয়া উঠিল ; জোড়হন্তে কহিল, “মা ভগবতী, আমাকে মারিয়া ফেলিয়ো না, আমাকে রক্ষা করো, আমি মরিলে যে আমার মা কঁদিবে, আমার অমর কঁদিবে।” ক্ৰমে বালিকা অচেতন হইয়া পড়িল। কমল আলুলিতকুম্ভলে শিথিল-অঞ্চলে তুষারে অর্ধমগ্ন হইয়া বৃক্ষচ্যুত মলিন ফুলটির মতো পথপ্রান্তে পড়িয়া রহিল। তুষারের উপর তুষার পড়িতে লাগিল, বালিকার বক্ষের উপর তুষারের কণা পড়িতেছে ও গলিতেছে। এবং ক্রমে জমিয়া যাইতেছে। এই আঁধার রাত্রিতে একজন পন্থও পথ দিয়া যাইতেছে না। বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। রাত্রি বাড়িতে লাগিল । বরফ জমিতে লাগিল। বালিকা একাকিনী শৈলপথে পড়িয়া রহিল। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ কমলের মাতা ভগ্ন কুটিরে রোগশয্যায় শয়ান। জীৰ্ণ গৃহ ভেদ করিয়া শীতের বাতাস তীব্ৰবেগে গৃহে প্রবেশ করিতেছে। বিধবা তৃণশয্যায় শুইয়া থারথার করিয়া কঁাপিতেছেন। গৃহ অন্ধকার, প্ৰদীপ জ্বলিবার লোক নাই। কমল প্রাতে ভিক্ষা করিতে গিয়াছে, এখনাে ফিরিয়া আসে নাই। ব্যাকুল বিধবা । প্রত্যেক পদশব্দে কমল আসিতেছে বলিয়া চমকিয়া উঠিতেছেন। কমলকে খুঁজিবার জন্য বিধবা কতবার উঠতে চেষ্টা করিয়াছেন, কিন্তু পারেন না। কত কী আশঙ্কায় আকুল হইয়া মাতা দেবতার নিকট কাতর ক্ৰন্দনে প্রার্থনা করিয়াছেন ; অশ্রুজলে কতবার কহিয়াছেন, “আমি হতভাগিনী, আমার মরণ হইল না কেন । কখনো ভিক্ষা করিতে জানে না যে বালিকা, তাহাকেও আজ অনাথার মতো দ্বারের বাহিরে দাড়াইতে হইল ? ক্ষুদ্র বালিকা অধিক দূর চলিতে পারে না— সে এই অন্ধকারে, তুষারে, বৃষ্টিতে কী করিয়া বঁচিবে।' উঠিতে পারেন না— অথচ কমলকে দেখিতে পাইতেছেন না, বিধবা বক্ষে করাঘাত করিয়া অধীর ভাবে কঁদিতে লাগিলেন। দুই-একজন প্রতিবাসী বিধবাকে দেখিতে আসিয়াছিল, বিধবা তাহাদের চরণ জড়াইয়া ধরিয়া সজল নয়নে কাতরভাবে মিনতি করিলেন, “আমার পথহারা কমল কোথায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, একবার তাহাকে খুঁজতে যাও।” বিধবা কাদিয়া কহিলেন, “একবায় যাও- আমি অনাথ, দরিদ্র, অর্থ নাই, তোমাদের কী দিব বলে। ক্ষুদ্র বালিকা, সে পথ চিনে না, সে আজ সমস্তদিন কিছু খায় নাই- তাহাকে মাতার ক্ৰোড়ে, আনিয়া দেও- ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করবেন।” কেহ শুনিল না। সে বৃষ্টিবাজে কে বাহির হইবে। সকলেই নিজ নিজ গৃহে ফিরিয়া গেল ।