পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓ፲፱q}ጂ§ bro আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মোহন উপহাসের স্বরে হাসিয়া কহিলেন, “এ কী অপূর্ব ব্যাপার। এত দিনের পর দরিদ্রের কুটিরে যে পদার্পণ হইল ?” বিধবা । উপহাস করিয়ো না । আমি দরিদ্র, তোমার কাছে ভিক্ষা চাহিতে আসিয়াছি । মোহন। কী হইয়াছে। বিধবা আদ্যোপােন্ত সমস্ত বৃত্তান্ত কহিলেন । মোহন জিজ্ঞাসা করিলেন, “তা, আমাকে কী করিতে হইবে।” বিধবা । কমলের প্রাণরক্ষা করিতে হইবে । মোহন । কেন, অমরসিংহ এখানে নাই ? বিধবা উপহাস বুঝিতে পারিলেন। কহিলেন, “মোহন, যদি বাসস্থান অভাবে আমাকে বনে বনে ভ্ৰমণ করিতে হইত, অন্যহারে ক্ষুধার জ্বালায় যদি পাগল হইয়া মরিতাম, তথাপি তোমার কাছে একটি তৃণও প্রার্থনা করিতাম না। কিন্তু আজ যদি বিধবার একমাত্র ভিক্ষা পূর্ণ না করে, তবে তোমার নিষ্ঠুরতা চিরকাল মনে থাকিবে ।” মোহন । আইস, তবে তোমাকে একটি কথা বলি। কমল দেখিতে কিছু মন্দ নহে, আর তাহাকে যে আমার পছন্দ হয় নাই এমনও নহে, তবে তাহার সহিত আমার বিবাহের আর তো কোনো আপত্তি দেখিতেছি না। তোমার কাছে ঢাকিয়া কী করিব, বিনা কারণে ভিক্ষা দিবার মতো আমার অবস্থা নহে। বিধবা । অগ্ৰেই যে অমরের সহিত তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়া গিয়াছে । মোহন কিছু উত্তর না দিয়া হিসাবের খাতা খুলিয়া লিখিতে বসিলেন। যেন কেহই ঘরে নাই, যেন কাহারও সহিত কিছু কথা হয় নাই। এ দিকে সময় বহিয়া যায়, দসু্য আছে কি গিয়াছে তাহার ঠিক নাই। বিধবা কাদিয়া কহিলেন, “মোহন, আর আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে না, সময় অতীত হইতেছে।” মোহন । রোসো, কাজ সারিয়া ফেলি । অবশেষে যদি বিধবা বিবাহের প্রস্তাবে সম্মত না হইতেন, তাহা হইলে সমস্তদিনে কাজ। সারা হইত। কি না সন্দেহস্থল । বিধবা মোহনলালের নিকট অর্থ লইয়া দসু্যকে দিলেন, সে চলিয়া গেল । সেই দিনই ভয়ে আশঙ্কায় ত্ৰস্ত হরিণীটির ন্যায় বিহবলা বালিকা মাতার ক্ৰোড়ে ফিরিয়া আসিল এবং তাহার বাহুপাশে মুখখানি প্রচ্ছন্ন করিয়া অনেকক্ষণ কাদিয়া কঁাদিয়া মনের বেগ শাস্ত করিল। কিন্তু অনাথিনী বালিকা এক দসু্যর হস্ত হইতে আর-এক দসুর হস্তে পড়িল । কত বৎসর গত হইয়া গেল। যুদ্ধের অগ্নি নির্বাপিত হইয়াছে। সৈনিকেরা দেশে ফিরিয়া আসিয়াছে ও অন্ত্র পরিত্যাগ করিয়া এক্ষণে ভূমি কর্ষণ করিতেছে। বিধবা সংবাদ পাইলেন যে, অজিতসিংহ হত ও অমর কারারুদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু কন্যাকে এ সংবাদ শুনান নাই। মোহনের সহিত বালিকার বিবাহ হইয়া গেল । মোহনের ক্ৰোধ কিছুমাত্র নিবৃত্ত হইল না। তাহার প্রতিহিংসাপ্রবৃত্তি বিবাহ করিয়াই তৃপ্ত হয় নাই। সে নির্দোষী অবলা বালার প্রতি অনৰ্থক পীড়ন করিত। কমল মাতৃক্ৰোড়ের স্নিগ্ধ মোহাচ্ছায়া হইতে এই নিষ্ঠুর কারাগৃহে আসিয়া অত্যন্ত কষ্ট পাইতেছে, অভাগিনী কঁদিতেও পায় না। বিন্দুমাত্র অশ্রু নেত্ৰে দেখা দিলে মোহনের ভৎসনার ভয়ে ত্ৰস্ত হইয়া মুছিয়া ফেলিত । পঞ্চম পরিচ্ছেদ শৈলশিখরের নিষ্কলঙ্ক তুষারদর্পণের উপর উষার রক্তিম মেঘমালা স্তরে স্তরে সজ্জিত হইল। ঘুমন্ত বিধবা দ্বারে আঘাত শুনিয়া জাগিয়া উঠিলেন। দ্বার খুলিয়া দেখিলেন, সৈনিকবেশে অমরসিংহ দাড়াইয়া আছেন। বিধবা কিছুই বুঝিতে পারিলেন না, দাড়াইয়া রহিলেন । অমর তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কমল, কমল কোথায় ।”