পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ما سواO\ বিনোদিনী কহিল, “ব্যস্ত হইয়ো না, আমি তোমার কাপড় আনিয়া দিই।” বলিয়া মহেঞ্জের কালেজের কাপড় বাহির করিয়া আনিল । মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কলেজে চলিয়া গেল, কিন্তু সেখানে কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিল না। পড়াশুনায় মন দিতে অনেকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করিয়া সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া আসিল । ঘরে ঢুকিয়া দেখে, বিনোদিনী বুকের তলায় বালিশ টানিয়া লইয়া নিচের বিছানায় উপুড় হইয়া কী একটা বই পড়িতেছে— রাশীকৃত কালো চুল পিঠের উপর ছড়ানো । বোধ করি বা সে মহেন্দ্রের জুতার শব্দ শুনিতে পায় নাই। মহেন্দ্র আস্তে আস্তে পা টিপিয়া কাছে আসিয়া দাড়াইল । শুনিতে পাইল, পড়িতে পড়িতে বিনোদিনী একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল । মহেন্দ্র কহিল, “ওগো করুণাময়ী, কাল্পনিক লোকের জন্য হৃদয়ের বাজে খরচ করিয়ো না। কী পড়া হইতেছে।” বিনোদিনী ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া বসিয়া তাড়াতাড়ি বইখানা অঞ্চলের মধ্যে লুকাইয়া ফেলিল। মহেন্দ্র কাড়িয়া দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল । অনেকক্ষণ হাতাহাতিকাড়াকড়ির পর পরাভূত বিমোদিনীর অঞ্চল হইতে মহেন্দ্র বইখানি ছিনাইয়া লইয়। দেখিল— বিষবৃক্ষ। বিনোদিনী ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে রাগ করিয়া মুখ ফিরাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। মহেন্দ্রের বক্ষঃস্থল তোলপাড় করিতেছিল। অনেক চেষ্টায় সে হাসিয়া কহিল, “ছি ছি, বড়ো ফাকি দিলে। আমি ভাবিয়াছিলাম, খুব একটা গোপনীয় কিছু হইবে বা । এত কাড়াকড়ি করিয়া শেষকালে কিনা বিষবৃক্ষ বাহির হইয়া পড়িল ।” বিনোদিনী কহিল, “আমার আবার গোপনীয় কী থাকিতে পারে, শুনি ।” মহেন্দ্র ফস করিয়া বলিয়া ফেলিল, “এই মনে করে, যদি বিহারীর কাছ হইতে কোনো চিঠি আসিত ?” নিমেষের মধ্যে বিনোদিনীর চোখে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইল। এতক্ষণ ফুলশর ঘরের কোণে খেলা করিতেছিল, সে যেন দ্বিতীয় বার ভস্মসাৎ হইয়া গেল। মুহূর্তে-প্ৰজলিত অগ্নিশিখার মতো বিনোদিনী উঠিয়া দাড়াইল । মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মাপ করে, আমার পরিহাস মাপ করো।” বিনোদিনী সবেগে হাত ছিনাইয়া লইয়া কহিল, "পরিহাস করিতেছ কাহাকে । যদি তাহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার যোগ্য হইতে, তবে তাহাকে পরিহাস করিলে সহ করিতাম। তোমার ছোটো মন, বন্ধুত্ব করিবার শক্তি নাই, অথচ ঠাট্টা।”