পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢२० রবীক্স-রচনাবলী ভারতবর্ষীয় সমাজ তুরস্ক যে যে জায়গা দখল করিয়াছে, সেখানে রাজশাসন এক কিন্তু আর-কোনো ঐক্য নাই। সেখানে তুকি, গ্রীক, আর্মানি, শ্লাভ, কুর্দ, কেহ কাহারও সঙ্গে না মিশিয়া, এমন কি পরস্পরের সহিত ঝগড়া করিয়া কোনো মতে একত্রে আছে । যেশক্তিতে এক করে, সেই শক্তিই সভ্যতার জননী— সেই শক্তি তুরস্করাজ্যের রাজলক্ষ্মীর মতো হইয়া এখনো আবিভূত হয় নাই । ጎ প্রাচীন যুরোপে বর্বর জাতেরা রোমের প্রকাগু সাম্রাজ্যটাকে বাটোয়ারা করিয়া লইল । কিন্তু তাহারা আপন আপন রাজ্যের মধ্যে মিশিয়া গেল— কোথাও জোড়ের চিহ্ন রাখিল না । জেতা ও বিজিত ভাষায় ধর্মে সমাজে একাঙ্গ হইয়া এক-একটি নেশন কলেবর ধরিল । সেই যে মিলনশক্তির উদ্ভব হইল, সেটা নানাপ্রকার বিরোধের আঘাতে শক্ত হইয়া সুনির্দিষ্ট আকার ধরিয়া সুদীর্ঘকালে এক-একটি নেশনকে একএকটি সভ্যতার আশ্রয় করিয়া তুলিয়াছে। যে কোনো উপলক্ষ্যে হউক অনেক লোকের চিত্ত এক হইতে পারিলে তাহাতে মহৎ ফল ফলে । যে জনসম্প্রদায়ের মধ্যে সেই এক হইবার শক্তি স্বভাবতই কাজ করে, তাহাদের মধ্য হইতেই কোনো না কোনো প্রকার মহত্ব অজধারণ করিয়া দেখা দেয়, তাহারাই সভ্যতাকে জন্ম দেয়, সভ্যতাকে পোষণ করে । বিচিত্রকে মিলিত করিবার শক্তিই সভ্যতার লক্ষণ। সভ্য যুরোপ জগতে সম্ভাব বিস্তার করিয়া ঐক্যসেতু বাধিতেছে— বর্বর যুরোপ বিচ্ছেদ, বিনাশ, ব্যবধান স্বজন করিতেছে, সম্প্রতি চীনে তাহার প্রমাণ পাওয়া গেছে । চীনে কেন, আমরা ভারতবর্ষে যুরোপের সভ্যতা ও বর্বরতা উভয়েরই কাজ প্রত্যক্ষ করিতে পাই । সকল সভ্যতার মর্মস্থলে মিলনের উচ্চ আদর্শ বিরাজ করিতেছে বলিয়াই, সেই আদর্শমূলে বিচার করিয়া বর্বরতার বিচ্ছেদঅভিঘাতগুলা দ্বিগুণ বেদনা ও অপমানের সহিত প্রত্যহ অকুভব করিয়া থাকি । এই লোকচিত্তের একতা সব দেশে এক ভাবে সাধিত হয় না। এইজন্য যুরোপীয়ের ঐক্য ও হিন্দুর ঐক্য এক প্রকারের নহে, কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দুর মধ্যে যে একটা ঐক্য নাই, সে-কথা বলা যায় না । সে-ঐক্যকে ন্যাশনাল ঐক্য না বলিতে পার,— কারণ নেশন ও ন্যাশনাল কথাটা আমাদের নহে, যুরোপীর ভাবের দ্বারা তাহার অর্থ সীমাবদ্ধ হইয়াছে । প্রত্যেক জাতি নিজের বিশেষ ঐক্যকেই স্বভাবত সব চেয়ে বড়ো মনে করে ।