পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আত্মশক্তি- (సిరి আমার আশঙ্কা হইতেছে, অন্তকার বক্তব্য বিষয় সম্বন্ধে আমি ঠিক মাত্রারক্ষা করিতে পারি নাই । কথাটা তো শুদ্ধমাত্র এই যে, দেশী ভাষার ব্যাকরণ চর্চা করে, অভিধান সংকলন করে, পল্লী হইতে দেশের আভ্যন্তরিক বিবরণ সংগ্রহ করে। এই সামান্য প্রস্তাবের অবতারণার জন্য এমন করিয়া উচ্চভাবের দোহাই দিয়া দীর্ঘ ভূমিকা রচনা করা কিছু যেন অসংগত হইয়াছে ৷ হইয়াছে স্বীকার করি—কিন্তু, কালের গতিকে এইরূপ অসংগত ব্যাপার অামাদের দেশে আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে, ইহাই আমাদের দুর্ভাগ্যের লক্ষণ। যদি কোনো মাতার এমন অবস্থা হয় যে, ছেলের প্রতি তাহার কর্তব্য কী, তাহাই নিরূপণ করিবার জন্য দেশবিদেশের বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্মশাস্ত্র পড়িয়া তিনি কুলকিনারা পাইতেছেন না, তবে তাহাকে এই অত্যন্ত সহজ কথাটি যত্ন করিয়া বুঝাইতে হয়— আগে দেখো তোমার ছেলেটা কোথায় আছে, কী করিতেছে, সে পাতকুয়ায় পড়িল কি আলপিন গিলিয়া বসিল, তাহার ক্ষুধা পাইয়াছে কী শীত করিতেছে। এ-সব কথা সাধারণত বলিতেই হয় না, কিন্তু যদি দুৰ্দৈবক্রমে বিশেষ স্থলে বলা আবশ্যক হইয় পড়ে, তবে বাহুল্য করিয়াই বলিতে হয় । বর্তমান কালে আমাদের দেশে যদি বলা যায় যে, দেশের জন্য বক্তৃতা করো, সভা করে, তর্ক করে, তবে তাহা সকলে অতি সহজেই বুঝিতে পারেন ; কিন্তু যদি বলা হয়, দেশকে জানো ও তাহার পরে স্বহস্তে যথাসাধ্য দেশের সেবা করে, তবে দেখিয়াছি, অর্থ বুঝিতে লোকের বিশেষ কষ্ট হয়। এমন অবস্থায় দেশের প্রতি কর্তব্য সম্বন্ধে দুটো-একটা সামান্য কথা বলিতে যদি অসামান্য বাক্যব্যয় করিয়া থাকি, তবে মার্জনা করিতে হইবে । বস্তুত, সকালবেলায় যদি ঘন কুয়াশা হইয়া থাকে তবে অধীর হইয়া ফল নাই এবং হতাশ হইবারও প্রয়োজন দেখি না— স্বর্য সে-কুয়াশা ভেদ করিবেনই এবং করিবামাত্র সমস্ত পরিষ্কার হইয়া যাইবে । আজ আমি অধীরভাবে অধিক আকাঙ্ক্ষা করিব না— অবিচলিত আশার সহিত আনন্দের সহিত এই কথাই বলিব, নিবিড় কুত্মটিকার মাঝে মাঝে ওই যে বিচ্ছেদ দেখা যাইতেছে— সূর্যরশ্মির ছটা খরধার কৃপাণের মতো আমাদের দৃষ্টির আবরণ তিন-চারি জায়গায় ভেদ করিয়াছে— আর ভয় নাই, গৃহদ্বারের সম্মুখেই আমাদের যাত্রাপথ অনতিবিলম্বে পরিস্ফুটন্ধপে প্রকাশিত হইয়া পড়িবে— তখন দিগবিদিক সম্বন্ধে দশ জন মিলিয়া দশ প্রকারের মত লইয়া ঘরে বসিয়া বাদবিতণ্ড করিতে হইবে না— তখন সকলে আপন-আপন শক্তি অনুসারে আপন.আপন পথ নির্বাচন করিয়া তর্কসভা হইতে, পুথির রুদ্ধ কক্ষ হইতে বাহির হইয়া পড়িব, তখন নিকটের কাজকে দূর মনে হইবে না এবং অত্যাবস্তক কাজকে ক্ষুদ্র বলিয়া অবজ্ঞা জন্মিবে না। এই শুভক্ষণ আসিবে বলিয়া আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস আছে—