পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী سیاه» কোনো হিসাব রাখেন না, ছেলেও বেশ পুষ্ট হয়— স্নেহবিহীন ধাত্রী বাজার হইতে খাবার কিনিয়া রোরুদ্যমান মুখের মধ্যে গুজিয়া দেয়, তাহার পরে অহরহ খিটখিট করিতে থাকে, “এত গিলাইতেছি, কিন্তু ছেলেট দিন দিন কেবল কাঠি হইয়া যাইতেছে।” আমাদের ইংরেজ কতৃপক্ষেরা সেই বুলি ধরিয়াছেন। পেডলার সেদিন বলিয়াছেন, “আমরা বিজ্ঞানচর্চার এত বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম, এত আহুকুল্য করিলাম, বৃত্তির টাকার এত অপব্যয় করিতেছি, কিন্তু ছাত্রেরা স্বাধীনবুদ্ধির কোনো পরিচয় দিতেছে না !” অনুগ্রহজীবৗদিগকে এই সব কথাই শুনিতে হয়— অথচ আমাদের বলিবার মুখ নাই, “বন্দোবস্ত সমস্ত তোমাদেরই হাতে, এবং সে-বন্দোবস্তে যদি যথেষ্ট ফললাভ না হয়, তাহার সমস্ত পাপ আমাদেরই !” এদিকে খাতায় টাকার অঙ্কটাও গ্রেটুপ্রাইমার অক্ষরে দেখানো হইতেছে— যেন এত বিপুল টাকা এতবড়ো প্রকাও অযোগ্যদের জন্য জগতে আর কোনো দাতাকৰ্ণ ব্যয় করে না, অতএব ইহার moral এই—“হে অক্ষম, হে অকৰ্মণ্য তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তোমরা রাজভক্ত হও, তোমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে চাদ দিতে কপোলযুগ পাণ্ডুবর্ণ করিয়ো না !” ইহাতে বিদ্যালাভ কতটুকু হয় জানি না, কিন্তু আত্মসম্মান থাকে না। আত্মসম্মান ব্যতীত কোনো জাত কোনো সফলতা লাভ করিতে পারে না— পরের ঘরে জল-তোলা এবং কাঠ-কাটার কাজে লাগিতে পারে, কিন্তু দ্বিজধর্ম অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্বের বৃত্তিরক্ষা করিতে পারে না । একটা কথা আমাদিগকে সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদিগকে যে খোটা দেওয়া হইয়া থাকে, তাহ সম্পূর্ণ অমূলক । এবং যাহারা খোটা দেন, তাহারাও যে মনে মনে তাহ জানেন না, তাহাও আমরা স্বীকার করিব না। কারণ, আমরা দেখিয়াছি পাছে র্তাহাদের কথা অপ্রমাণ হইয়া যায়, এজন্ত র্তাহারা ত্রস্ত আছেন। এ-কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে, বিলাতি সভ্যতা বস্তুত দুরূহ ও দুর্লভ ময় । স্বাধীন জাপান আজ পঞ্চাশ বৎসরে এই সভ্যতা আদায় করিয়া লইয়া গুরুমার বিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হইয়াছে। এ সভ্যতা অনেকটা ইস্কুলের জিনিস, পরীক্ষা করা, মুখস্থ করা, চর্চা করার উপরেই ইহার নির্ভর। জাপানের মতো সম্পূর্ণ স্থযোগ ও আমুকুল্য পাইলে এই ইস্কুলপাঠ আমরা পেডলার-সম্প্রদায় আসিবার বহুকাল পূর্বেই শেষ করিতে পারিতাম। প্রাচ্য সভ্যতা ধৰ্মগত, তাহার পথ নিশিত ক্ষুরধারের স্তায় দুর্গম— তাহ ইস্কুলের পড়া নহে, তাহা জীবনের সাধন ।