পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অবিশ্বাস করিবার একটা শক্তি মানুষের পক্ষে অবশ্যপ্ৰয়োজনীয় । ইহা কেবল একটা নেতিভাবক গুণ নহে, ইহা কতৃভাবক । মনুষ্যত্বকে রক্ষা করিতে হইলে এই অবিশ্বাসের ক্ষমতাকে নিজের শক্তির দ্বারা খাড়া করিয়া রাখিতে হয় । যিনি বিজ্ঞান চৰ্চায় প্ৰবৃত্ত, তঁহাকে অনেক জনশ্ৰীতি, অনেক প্ৰমাণহীন প্ৰচলিত ধারণাকে অবিশ্বাসের জোরে খেদাইয়া রাখিতে হয়, নহিলে তাহার বিজ্ঞান পণ্ড হইয়া যায় । যিনি কৰ্ম করিতে চান, অবিশ্বাসের নিড়ানির দ্বারা তঁহাকে কৰ্মক্ষেত্ৰ নিষ্কণ্টক রাখিতে হয় । এই যে অবিশ্বাস, ইহা অন্যের উপরে অবজ্ঞা বা ঈৰ্ষাবশত নহে, নিজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি, নিজের কৰ্তব্যসাধনার প্রতি সন্মানবশত । অামাদের দেশে ইংরেজ-রাজনীতিতে অবিশ্বাস যে কিরুপ প্ৰবল সতৰ্কতার সঙ্গে কাজ করিতেছে এবং সেই অবিশ্বাস যে কিরুপ নিৰ্মমভাবে আপনার লক্ষ্যসাধন করিতেছে, তাহা পূর্বেই বলিয়াছি । উচ্চ ধৰ্মনীতির নহে, কিন্তু সাধারণ রাজনীতির দিক দিয়া দেখিলে এই কঠিন অটল অবিশ্বাসের জন্য ইংরেজকে দোষ দেওয়া যায় না । ঐক্যের যে কী শক্তি, কী মাহাত্ম্য, তাহা ইংরেজ আমাদের চেয়ে ভালো করিয়াই জানে। ইংরেজ জানে, ঐক্যের অনুভূতির মধ্যে কেবল একটা শক্তিমাত্ৰ নহে, পরন্তু এমন একটা আনন্দ অাছে যে সেই অনুভূতির আবেগে মানুষ সমস্ত দুঃখ ও ক্ষতি তুচ্ছ করিয়া অসাধ্যসাধনে প্ৰবৃত্ত হয় । ইংরেজ আমাদের চেয়ে ভালো করিয়াই জানে যে ক্ষমতা-অনুভূতির স্মৃতি মানুষকে কিরুপ একটা প্রেরণা দান করে । উচ্চ অধিকার লাভ করিয়া রক্ষা করিতে পারিলে সেইখানেই তাহা অামাদিগকে থাকিতে দেয় না—উচ্চতর অধিকারলাভের জন্য আমাদের সমস্ত প্ৰকৃতি উন্মুখ হইয়া উঠে । আমাদের শক্তি নাই, আমরা পারি না, এই ভয়ংকর মোহ । যে ব্যক্তি মোেহই সকলের চেয়ে ক্ষমতা প্ৰয়োগের অধিকার পায় নাই, সে আপনার শক্তির স্বাদ জানে না ; সে নিজেই নিজের পরম শত্ৰু । সে জানে যে আমি অক্ষম, এবং এইরুপ জানাই তাহার দারুণ দুৰ্বলতার কারণ । এরুপ অবস্থায় ইংরেজ যে আমাদের মধ্যে ঐক্যবন্ধনে পোলিটি কাল হিসাবে আনন্দবোধ করিবে না, অামাদের হাতে উচ্চ অধিকার দিয়া অামাদের ক্ষমতার অনুভূতিকে উত্তরোত্তর সবল করিয়া তুলিবার জন্য আগ্ৰহ অনুভব করিবে না। এ-কথা বুঝিতে অধিক মননশক্তির প্রয়োজন হয় না । অামাদের দেশে যে-সকল পোলিটিকাল প্ৰাৰ্থনা-সভা স্থাপিত হইয়াছে তাহারা যদি ভিক্ষুকের রীতিতেই ভিক্ষা করিত তাহা হইলেও হয়তো মাঝে মাঝে দরখাস্ত মঞ্জর হইত— কিন্তু তাহারা গৰ্জন করিয়া ভিক্ষা করে, তাহারা দেশবিদেশের লোক একত্ৰ করিয়া ভিক্ষা করে, তাহারা ভিক্ষাবৃত্তিকে একটা শক্তি করিয়া তুলিতে চেষ্টা করে, সুতরাং এই শক্তিকে প্ৰশ্ৰয় দিতে ৩০- ৭৭