পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি N কবিতেছে, তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে । রমেশ সান্তনার কোনো কথা না বলিয়া বালিকার কাছে ঘেষিয়া বসিয়া আস্তে আস্তে তাহার মাথায় পিঠে হাত বুলাইতে লাগিল। তাহার কান্না আর চাপ বহিল না— অব্যক্তকণ্ঠে উচ্ছসিত হইয়া উঠিল । রমেশের দুই চক্ষু দিয়াও জলধারা ঝরিয়া পড়িল । শ্ৰান্ত হৃদয় যখন রোদন বন্ধ করিল, তখন চন্দ্ৰ অস্ত গেছে । অন্ধকারের মধ্য দিয়া এই নির্জন ধবাখণ্ড অদ্ভুত স্বপ্নের মতো বােধ হইল। বালুচরের অপরিস্ফুট শুভ্রতা প্রেতলোকের মতো পাণ্ডুবৰ্ণ । নক্ষত্রের ক্ষীণালোকে নদী অজগর সাপের চিঙ্কণ কৃষ্ণচমের মতো স্থানে স্থানে ঝিকঝিকা করিতেছে । তখন রমেশ বালিকার ভয়শীতল কোমল ক্ষুদ্র দুইটি হাত দুই হাতে তুলিয়া লইয়া বধূকে আপনার দিকে ধীরে আকর্ষণ করিল। শঙ্কিত বালিকা কোনো বাধা দিল না। মানুষকে কাছে অনুভব করিবার জনা সে তখন ব্যাকুল । আটল অন্ধকারের মধ্যে নিশ্বাসস্পন্দিত। রমেশের বক্ষপটে আশ্রয় লাভ করিয়া সে আরাম বোধ করিল। তখন তাহার লজ্জা করিবার সময় নহে। রমেশের দুই বাহুর মধ্যে সে আপনি নিবিড় আগ্রহের সহিত আপনার স্থান করিয়া লইল । প্রত্যুষের শুকতারা যখন অস্ত যায়-যায়, পূর্ব দিকের নীল নদীরেখার উপরে প্রথমে আকাশ যখন পাণ্ডুবৰ্ণ ও ক্রমশ রক্তিম হইয়া উঠিল, তখন দেখা গেল নিদ্রাবিহবল রমেশ বালির উপরে শুইয়া পডিয়াছে এবং তাহার বুকের কাছে বাহুতে মাথা রাখিয়া নববধূ সুগভীর নিদ্রায় মগ্ন। অবশেষে প্রভাতের মৃদু রৌদ্র যখন উভয়ের চক্ষুপুট স্পর্শ করিল, তখন উভয়ে শশব্যস্ত হইয়া জাগিয়া উঠিয়া বসিল । বিস্মিত হইয়া কিছুক্ষণের জন্য চারিদিকে চাহিল ; তাহার পরে হঠাৎ মনে পড়িল যে, তাহারা ঘরে নাই, মনে পড়িল তাহারা ভাসিয়া আসিয়াছে। 8 সকালবেলায় জেলেডিঙির সাদা-সাদা পালে নদী খচিত হইয়া উঠিল । রমেশ তাহারই একটিকে ডাকাডাকি করিয়া লইয়া জেলেদের সাহায্যে একখানি বড়ো পানসি ভাড়া করিল এবং নিরুদেশ আত্মীয়দের সন্ধানের জন্য পুলিস নিযুক্ত করিয়া বধূকে লইয়া গৃহে রওনা হইল। গ্রামের ঘাটের কাছে নীেকা পৌছিতেই রমেশ খবর পাইল যে, তাহার পিতার, শাশুড়ির ও আরকয়েকটি আত্মীয়-বন্ধুর মৃতদেহ নদী হইতে পুলিস উদ্ধার করিয়াছে । জনকয়েক মাল্লা ছাড়া আর-যে কেহ বাচিয়াছে, এমন আশা আর কাহারও রহিল না । বাড়িতে রমেশের বৃদ্ধ ঠাকুরমা ছিলেন, তিনি বধূসহ রমেশকে ফিরিতে দেখিয়া উচ্চকলরবে কাদিতে লাগিলেন । পাড়ার যে-সকল বরযাত্র গিয়াছিল, তাহদেরও ঘরে ঘরে কান্না পড়িয়া গেল । শাক বাজিল না, হুলুধ্বনি হইল না, কেহ বধূকে বরণ করিয়া লইল না, কেহ তাহার দিকে তাকাইল না। a শ্ৰাদ্ধশান্তি শেষ হইবার পরেই রমেশ বধূকে লইয়া অন্যত্র যাইবে স্থির করিয়াছিল— কিন্তু পৈতৃক বিষয়সম্পত্তির ব্যবস্থা না করিয়া তাহার শীঘ্র নড়িবার জো ছিল না। পরিবারের শোকাতুর স্ত্রীলোকগণ তীর্থবাসের জন্য তাঁহাকে ধরিয়া পড়িয়াছে তাহারও বিধান করিতে হইবে । এই-সকল কাজকর্মের অবকাশকালে রমেশ প্রণয়চর্চায় অমনোযোগী ছিল না। যদিও পূর্বে যেমন শুনা গিয়াছিল, বধু তেমন নিতান্ত বালিকা নয়, এমন-কি, গ্রামের মেয়েরা ইহাকে অধিকবয়স্ক বলিয়া ধিক্কার দিতেছিল, তবু ইহার সহিত কেমন করিয়া যে প্রণয় হইতে পারে, এই বি. এ. পাস-করা ছেলেটি তাহার কোনো পুঁথির মধ্যে সে উপদেশ প্রাপ্ত হয় নাই। সে চিরকাল ইহা অসম্ভব এবং অসংগত বলিয়াই জানিত। তবু কোনো বই-পড়া অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিছুমাত্র না মিলিলেও, আশ্চর্য এই যে, তাহার উচ্চশিক্ষিত মন ভিতরে-ভিতরে একটি অপরূপ রসে পরিপূর্ণ হইয়া এই ছোটাে মেয়েটির দিকে অবনত হইয়া পড়িয়াছিল। সে এই বালিকার মধ্যে কল্পনার দ্বারা তাহার ভবিষ্যৎ গৃহলক্ষ্মীকে উদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছে ; সেই উপায়ে তাহার স্ত্রী একই কালে বালিকা বধূ, তরুণী প্ৰেয়সী এবং সন্তানদিগের