পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NR > br রবীন্দ্র-রচনাবলী রাস্তায় একটি চিরকিশোর প্রাচীন দেবতা তাহার ধনুকটি গোপন করিয়া লালপাগড়ি প্রহরীদের চক্ষেপ সম্মুখ দিয়া কত রাত্রে কত দিনে কত বার কত ঠিকানায় যে আনাগোনা করিতেছেন, তাহা কে বলিতে পারে । রমেশ ও হেমনলিনী চামড়ার দোকানের সামনে, মুদির দোকানের পাশে, কলুটােলায় ভাড়াটে বাড়িতে বাস করিতেছিল বলিয়া প্রণয়বিকাশ সম্বন্ধে কুঞ্জকুটিরচারীদের চেয়ে তাহারা যে কিছুমাত্র পিছাইয়া ছিল, এমন কথা কেহ বলিতে পারে না । অন্নদাবাবুদের চা-রস-চিহ্নিত মলিন ক্ষুদ্র টেবিলটি পদ্মসরোবর নহে বলিয়া রমেশ কিছুমাত্র অভাব অনুভব করে নাই | হেমনলিনীর পোষা বিড়ালটি কৃষ্ণসার মৃগশাবক না হইলেও রমেশ পরিপূর্ণ স্নেহে তাহার গলা চুলকাইয়া দিত— এবং সে যখন ধনুকের মতো পিঠ ফুলাইয়া আলস্যত্যাগপূর্বক গাত্ৰলেহন দ্বারা প্রসাধনে রত হইত। তখন রমেশের মুগ্ধদৃষ্টিতে এই প্ৰাণীটি গৌরবে অন্য কোনো চতুষ্পদের চেয়ে ন্যূন বলিয়া প্রতিভাত হইত না । হেমনলিনী পরীক্ষা পাস করিবার ব্যগ্রতায় সেলাইশিক্ষায় বিশেষ পঢ়ত্ব লাভ করিতে পারে নাই, কিছুদিন হইতে তাহার এবং সীবনপঢ়ি সখীর কাছে একাগ্রমনে সে সেলাই শিখিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে । সেলাই ব্যাপারটাকে রমেশ অত্যন্ত অনাবশ্যক ও তুচ্ছ বলিয়া জ্ঞান করে | সাহিত্যে দর্শনে হেমনলিনীর সঙ্গে তাহার দেনাপাওনা চলে— কিন্তু সেলাই ব্যাপারে রমেশকে দূরে পড়িয়া থাকিতে হয় । এইজন্য সে প্রায়ই কিছু অধীর হইয়া বলিত, “আজকাল সেলাইয়ের কাজ কেন আপনার এত ভালো লাগে % যাহাঁদের সময় কাটাইবার আর কোনো সদুপায় নাই, তাহাদের পক্ষেই ইহা ভালো। ” হেমনলিনী কোনো উত্তর না দিয়া ঈষৎ হাসামুখে ছুচে রেশম পরাইতে থাকে । অক্ষয় তীব্রস্বরে বলে, "যে-সকল কাজ সংসারের কোনো প্রয়োজনে লাগে, রমেশবাবুর বিধানমতে সে-সমস্ত তুচ্ছ । মশায় য৩-বড়োই ৩ত্ত্বজ্ঞানী এবং কবি হােন-না কেন, তুচ্ছকে বাদ দিয়া একদিনও চলে না ।” রমেশ উত্তেজিত হইয়া ইহার বিরুদ্ধে তর্ক করিবার জন্য কোমর বাধিয়া বসে ; হেমনলিনী বাধা দিয়া বলে, “রমেশবাবু, আপনি সকল কথারই উত্তর দিবার জন্য এত বাস্ত হন কেন ? ইহাতে সংসারে অনাবশাক কথা যে কত বাডিয়া যায়, তাহার ঠিক নাই ।” এই বলিয়া সে মাথা নিচু করিয়া ঘর গনিয়া সাবধানে রেশমসূত্র চালাইতে প্ৰবৃত্ত হয় । একদিন সকালে রমেশ তাহার পড়িবার ঘরে আসিয়া দেখে, টেবিলের উপর রেশমের ফুলকটা মখমলে বাধানো একটি ব্লটিং-বহি সাজানো রহিয়াছে । তাহার একটি কোণে 'র' অক্ষর লেখা আছে, আর এক কোণে সোনালি জরি দিয়া একটি পদ্ম আঁকা। বইখানির ইতিহাস ও তাৎপর্য বুঝিতে রমেশের ক্ষণমাত্রও বিলম্ব হইল না । তাহার বুক নাচিয়া উঠিল । সেলাই জিনিসটা তুচ্ছ নহে, তাহা তাহার অন্তরাত্মা বিনা তর্কে, বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করিয়া লইল । ব্লটিং-বইটা বুকে চাপিয়া ধরিয়া সে অক্ষয়ের কাছেও হার মানিতে রাজি হইল ; সেই ব্লটিং-বই খুলিয়া তখনই তাহার উপরে একখানি চিঠিব। কাগজ রাখিয়া সে লিখিল— “আমি যদি কবি হাইতাম, তবে কবিতা লিখিয়া প্রতিদান দিতাম, কিন্তু প্ৰতিভা হইতে আমি বঞ্চি৩ ! ঈশ্বর আমাকে দিবার ক্ষমতা দেন নাই, কিন্তু লইবার ক্ষমতাও একটা ক্ষমতা । আশাতীত উপহাব আমি যে কেমন করিয়া গ্রহণ করিলাম, অন্তৰ্য্যামী ছাড়া তাহা আর কেহ জানিতে পাৰিবে না দান চোখে দেখা যায়, কিন্তু আদান হৃদয়ের ভিতরে লুকানো ! ইতি চিবাঝণী৷ ” এই লিখন টুকু হেমনলিনীর হাতে পড়িল । তাহার পরে এ সম্বন্ধে উভয়ের মধ্যে আর-কোনো কথাই হইল না ! বর্ষাকাল ঘনাইয়া আসিল । বৰ্ষাঋতুটা মোটের উপরে শহুরে মনুষ্যসমাজের পক্ষে তেমন সুখকর নহে— ওটা আরণ্যপ্রকৃতিরই বিশেষ উপযোগী ; শহরের বাড়িগুলা তাহার রুদ্ধ বাতায়ন ও ছাদ লইয়া, পথিক তাহার ছাতা লইয, ট্রামগাড়ি তাহার পর্দা লইয়া, বর্ষাকে কেবল নিষেধ করিবার চেষ্টায় ক্লেদাক্ত পঙ্কিল হইয়া উঠিতেছে। নদী-পৰ্ব্বত-অরণ্য-প্রান্তর বর্ষাকে সাদর কলরবে বন্ধু বলিয়া আহবান