পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি SOA রমেশের সঙ্গে দেখা করাইয়া দিব ।” f যোগেন্দ্ৰ কহিল, “কাণ্ডখন কী বলে দেখি। তোমরা সবাই যে মূর্তিমান হেঁয়ালি হইয়া উঠিলে। আমি এই কদিন মাত্র বেড়াইতে গেছি, সেই সুযোগে পৃথিবীটা এমন ভয়ানক রহস্যময় হইয়া উঠিল! না না অক্ষয়, অমন ঢাকাঢাকি করিলে চলিবে না।” অক্ষয় । শুনিয়া খুশি হইলাম । ঢাকাঢাকি করি নাই বলিয়া আমার পক্ষে একপ্রকার অচল হইয়া উঠিয়াছে— তোমার বােন তো আমার মুখ দেখা বন্ধ করিয়াছেন, তোমার বাবা আমাকে সন্দিগ্ধপ্রকৃতি বলিয়া গালি দেন, আর রমেশবাবুও আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে আনন্দে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠেন না। এখন কেবল তুমিই বাকি আছ। তোমাকে আমি ভয় করি—তুমি সূক্ষ্ম আলোচনার লোক নও, মোটা কাজটাই তোমার সহজে আসে— আমি কাহিল মানুষ, তোমার ঘা আমার সহ্য হইবে না। যোগেন্দ্র। দেখো অক্ষয়, তোমার ঐ-সকল প্যাচালো চাল আমার ভালো লাগে না । বেশ বুঝতেছি একটা কী খবর তোমার বলিবার আছে, সেটাকে আড়াল করিয়া অমন দর-বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিতেছ। কেন ? সরলভাবে বলিয়া ফেলো, চুকিয়া যাক । অক্ষয় । আচ্ছ বেশ, তাহা হইলে গোড়া হইতেই বলি- তুমি অনেক কথাই জান না। S br রমেশ দরজিপাড়ায় যে বাসায় ছিল, সে বাসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হইয়া যায় নাই, তাহা আর-কাহাকেও ভাড়া দেওয়া সম্বন্ধে রমেশ চিন্তা করিবার অবসর পায় নাই। সে এই কয়েক মাস সংসারের বাহিরে উধাও হইয়া গিয়াছিল, লাভক্ষতিকে বিচারের মধ্যেই আনে নাই । আজ সে প্রত্যুষে সেই বাসায় গিয়া ঘর-দুয়ার সাফ করাইয়া লইয়াছে, তক্তপোশের উপর বিছানা পাতাইয়াছে এবং আহারাদিরও বন্দােবস্ত করিয়া রাখিয়াছে। আজ ইস্কুলে ছুটির পর কমলাকে আনিতে श् । সে এখনো দেরি আছে। ইতিমধ্যে রমেশ তক্তপোশের উপর চিত হইয়া ভবিষ্যতের কথা ভাবিতে লাগিল ৷ এটােয়া সে কখনো দেখে নাই- কিন্তু পশ্চিমের দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন নহে । শহরের প্রান্তে তাহার বাড়ি- তরুশ্রেণীদ্বারা ছায়াখচিত বড়ো রাস্তা তাহার বাগানের ধারা দিয়া চলিয়া গেছে— রাস্তার ও পারে প্রকাণ্ড মাঠ, তাহার মাঝে মাঝে কৃপ, মাঝে মাঝে পশুপক্ষী তাড়াইবার জন্য মাচা বাধা । ক্ষেত্ৰসেচনের জন্য গোরু দিয়া জল তোলা হইতেছে, সমস্ত মধ্যাহ্নে তাহার করুণ শব্দ শোনা যায়- রাস্তা দিয়া প্রচুর ধূলা উড়াইয়া মাঝে মাঝে এক্কাগাড়ি ছুটিয়াছে, তাহার ঝন ঝন শব্দে রৌদ্রদগ্ধ আকাশ জাগিয়া উঠিতেছে। এই সুদূর প্রবাসের প্রখর তাপ, উদাস মধ্যাহ্ন ও শূন্য নির্জনতার মধ্যে সে তাহার রুদ্ধদ্বার বাংলাঘরে সমস্ত দিন হেমনলিনীকে এক কল্পনা করিতে গেলে ক্লেশ অনুভব করিত । তাহার পাশে চিরসখীরূপে কমলাকে দেখিয়া সে আরামবোধ করিল। রমেশ ঠিক করিয়াছে, এখন সে কমলাকে কিছু বলিবে না। বিবাহের পর হেমনলিনী তাহাকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া সুযোগ বুঝিয়া সকরুণ স্নেহের সহিত ক্রমে ক্রমে তাহাকে তাহার প্রকৃত ইতিহাস জানাইবে, যত অল্প বেদনা দিয়া সম্ভব কমলার জীবনের এই জটিল রহস্যজাল ধীরে ধীরে ছাড়াইয়া দিবে। তাহার পরে সেই দূর বিদেশে তাঁহাদের পরিচিত সমাজের বাহিরে, কোনোপ্রকার আঘাত না পাইয়া কমলা অতি সহজেই তাঁহাদের সঙ্গে মিশিয়া আপনার হইয়া যাইবে । তখন দ্বিপ্রহরে গলি নিস্তব্ধ ; যাহারা আপিসে যাইবার, তাহারা আপিসে গেছে, যাহারা না। যাইবার, তাহারা দিবানিদ্রার আয়োজন করিতেছে। অনতিতপ্ত আশ্বিনের মধ্যাহ্নটি মধুর হইয়া উঠিয়াছেআগামী ছুটির উল্লাস এখনই যেন আকাশকে আনন্দের আভাস দিয়া মাখাইয়া রাখিয়ছে। রমেশ তাহার নিৰ্জন বাসায় নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে সুখের ছবি উত্তরোত্তর ফলাও করিয়া আঁকিতে লাগিল । এমন সময়ে খুব একটা ভারী গাড়ির শব্দ শোনা গৈল । সে গাড়ি রমেশের বাসার দ্বারের কাছে