পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

§0by রবীন্দ্র-রচনাবলী আসিয়া থামিল। রমেশ বুঝিল, ইস্কুলের গাড়ি কমলাকে পীেছাইয়া দিতে আসিতেছে। তাহার বুকের ভিতরটা চঞ্চল হইয়া উঠিল। কমলাকে কিরূপ দেখিবে, তাহার সঙ্গে কী ভাবে কথাবার্তা হইবে, কমলাই বা রমেশকে কী ভাবে গ্রহণ করিবে, হঠাৎ এই চিন্তা তাহাকে আন্দোলিত করিয়া তুলিল । নীচে তাহার দুই জন চাকর ছিল— প্রথমে তাহারা ধরাধরি করিয়া কমলার তোরঙ্গ লইয়া আসিয়া বারান্দায় রাখিল— তাহার পশ্চাতে কমলা ঘরের দ্বারের সম্মুখ পর্যন্ত আসিয়া থমকিয়া দাড়াইল, ভিতরে প্রবেশ করিল না । রমেশ কহিল, “কমলা, ঘরে এসো ।” কমলা একটা সংকোচের আক্রমণ কাটাইয়া লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। ছুটির সময়ে রমেশ তাহাকে বিদ্যালয়ে ফেলিয়া রাখিতে চাহিয়াছিল, সে কান্নাকাটি করিয়া চলিয়া আসিয়াছে, এই ঘটনায় এবং কয়েক মাসের বিচ্ছেদে রমেশের সঙ্গে তাহার যেন একটু মনের ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে। তাই কমলা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া রমেশের মুখের দিকে না চাহিয়া একটুখানি ঘাড় বাকাইয়া খোলা দরজার বাহিরে চাহিয়া রহিল । রমেশ কমলাকে দেখিবামাত্র বিস্মিত হইয়া উঠিল। যেন তাহাকে আর-একবার নূতন করিয়া দেখিল । এই কয় মাসে তাহার আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিয়াছে। অনতিপল্পবিতা লতার মতো সে অনেকটা বাড়িয়া উঠিয়াছে। পাড়ার্গেয়ে মেয়েটির অপরিস্ফুট সর্বাঙ্গে প্রচুর স্বাস্থের যে একটি পরিপুষ্টতা ছিল, সে কোথায় গেল ? তাহার গোলগাল মুখটি ঝরিয়া লম্বা হইয়া একটি বিশেষত্ব লাভ করিয়াছে, তাহার গালদুটি পূর্বের শ্যামভি চিকুণতা ত্যাগ করিয়া কোমল পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া আসিয়াছে, এখন তাহার গতিবিধি-ভাবভঙ্গিতে কোনোপ্রকার জড়তা নাই। আজ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া যখন সে ঋজুদেহে ঈষৎ-বঙ্কিম-মুখে খোলা জানালার সম্মুখে দাড়াইল, তাহার মুখের উপরে শরৎ-মধ্যাহের আলো আসিয়া পড়িল, তাহার মাথায় কাপড় নাই, অগ্রভাগে। লাল ফিতার গ্রন্থিবাধা বেণীটি পিঠের উপরে পড়িয়াছে, ফিকে হলদে রঙের মেরিনের শাড়ি তাহার স্মৃটিনােমুখ শরীরকে আঁটিয়া বেষ্টন করিয়াছে— তখন রমেশ তাহার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া চুপ করিয়া রহিল। কমলার সৌন্দর্য এই কয় মাসে রমেশের মনে আবছায়ার মতো হইয়া আসিয়াছিল, আজ সেই প্রভৃতির বিকাশ লাভ করা হয় তাহাক চাব লগীয় দল। সে নে স্থার চল প্রঃ छ्6 5 ।। রমেশ কহিল, “কমলা, বোসে ।” কমলা একটা চৌকিতে বসিল। রমেশ কহিল, “ইস্কুলে তােমার পড়াশুনা কেমন চলিতেছে ?" | কমলা অত্যন্ত সংক্ষেপে কহিল, “ বেশ ।” রমেশ ভাবিতে লাগিল। এইবার কী বলা যাইবে । হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া গেল ; কহিল, “বোধ হয় অনেকক্ষণ খাও নাই। তোমার খাবার তৈরি আছে। এইখানেই আনিতে বলি ?” কমলা কহিল, “খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।” রমেশ কহিল, “একটু কিছু খাইবে না ? মিষ্টি না খাও তো ফল আছে— আতা, আপেল, বেদনা-" কমলা কোনো কথা না বলিয়া ঘাড় নীড়িল । রমেশ আর-একবার কমলার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল । কমলা তখন ঈষৎ মুখ নত করিয়া তাহার ইংরাজিশিক্ষার বহি হইতে ছবি দেখিতেছিল। সুন্দর মুখ সোনার কাঠির মতো নিজের চারি দিকের সুপ্ত সৌন্দর্যকে জাগাইয়া তোলে । শরতের আলোক হঠাৎ যেন প্ৰাণ পাইল, আশ্বিনের দিন যেন আকার ধারণ করল । কেন্দ্র যেমন তাহার পরিধিকে নিয়মিত করে- তেমনি এই মেয়েটি আকাশকে, বাতাসকে, আলোককে আপনার চারিদিকে যেন বিশেষভাবে আকর্ষণ করিয়া আনিলঅথচ সে নিজে ইহার কিছুই না জানিয়া চুপ করিয়া বসিয়া তাহার পড়বার বইয়ের ছবি দেখিতেছিল । রমেশ তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া একটা থালায় কতকগুলি আপেল, নাসপাতি, বেদােনা লইয়া