পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S8V» রবীন্দ্র-রচনাবলী চেষ্টা করিল। অন্নদাবাবু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মা ! রমেশকে আমি খুব জানি— সে কখনােই অবিশ্বাসী নয়, যোগেন নিশ্চয়ই ভুল করিয়াছে।” যোগেন্দ্ৰ আর থাকিতে পারিল না ; কহিল, “বাবা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে না। এখনকার মতো কটু বঁাচাইতে গিয়া উহাকে দ্বিগুণ কষ্টে ফেলা হইবে । বাবা, হেমকে এখন কিছুক্ষণ ভাবিবার সময় দাও।” হেমনলিনী তখনই পিতার জানু ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল, এবং যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমার যােহা ভাবিবার, সব ভাবিয়ছি। যতক্ষণ র্তাহার নিজের মুখ হইতে না শুনিব, ততক্ষণ আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করিব না। ইহা নিশ্চয় জানিয়ো ।” r এই কথা বলিয়া সে উঠিয়া পড়িল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া তাহাকে ধরিলেন, কহিলেন, “পডিয়া যাইবে ।” হেমনলিনী অন্নদাবাবুর হাত ধরিয়া তাহার শোবার ঘরে গেল। বিছানায় শুইয়া কহিল, “বাবা, আমাকে একটুখানি একলা রাখিয়া যাও, আমি ঘুমাইব ।” অন্নদাবাবু কহিলেন, “হারির মাকে ডাকিয়া দিব ? বাতাস করিবে ?” হেমনলিনী কহিল, “বাতাসের দরকার নাই বাবা ?” অন্নদাবাবু পাশের ঘরে গিয়া বসিলেন । এই কন্যাটিকে ছয় মাসের শিশু-অবস্থায় রাখিয়া ইহার মা মারা যায়, সেই হেমের মার কথা তিনি ভাবিতে লাগিলেন । সেই সেবা, সেই ধৈর্য, সেই চিরপ্রসন্নতা মনে পড়িল। সেই গৃহলক্ষ্মীরই প্রতিমার মতো যে মেয়েটি এতদিন ধরিয়া তাহার কোলের উপর বাড়িয়া উঠিয়াছে তাহার অনিষ্ট-আশঙ্কায় তাহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। পাশের ঘরে বসিয়া বসিয়া তিনি মনে মনে তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, 'মা, তোমার সকল বিয়ু দূর হউক, চিরদিন তুমি সুখে থাকে । তোমাকে সুখী দেখিয়া, সুস্থ দেখিয়া, যাহাকে ভালোবাস তাহার ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর মতো প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া, আমি যেন তোমার মার কাছে যাইতে পারি।” এই বলিয়া জামার প্রান্তে আর্দ্র চক্ষু মুছিলেন। মেয়েদের বুদ্ধির প্রতি যোগেন্দ্রের পূর্ব হইতেই যথেষ্ট অবজ্ঞা ছিল, আজ তাহা আরো দৃঢ় হইল। ইহারা প্রত্যক্ষ প্রমাণও বিশ্বাস করে না— ইহাদিগকে লইয়া কী করা যাইবে ? দুইয়ে দুইয়ে যে চার হইবেই, তাহাতে মানুষের সুখই হউক আর দুঃখই হউক, তাহা ইহারা স্থলবিশেষে অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারে। যুক্তি যদি কালোকে কালেই বলে, আর ইহাদের ভালোবাসা তাহাকে বলে সাদা, তবে যুক্তি-বেচারার উপরে ইহারা ভারি খাপা হইয়া উঠিবে। ইহাদিগকে লইয়া যে কী করিয়া সংসার চলে তাহা যোগেন্দ্র কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না। যোগেন্দ্ৰ ডাকিল, “অক্ষয় ?” অক্ষয় ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করিল। যোগেন্দ্ৰ কহিল, “সব তো শুনিয়াছ, এখন ইহার উপায় ही ?" অক্ষয় কহিল, “আমাকে এ-সব কথার মধ্যে কেন মিছামিছিটানো ভাই ? আমি এতদিন কোনো কথাই বলি নাই, তুমি আসিয়াই আমাকে এই মুশকিলে ফেলিয়াছ।” যোগেন্দ্র । আচ্ছা, সে-সব নালিশের কথা পরে হইবে । এখন হেমনলিনীর কাছে রমেশকে নিজের মুখে সকল কথা কবুল না করাইলে উপায় দেখি না। অক্ষয় । পাগল হইয়াছ! মানুষ নিজের মুখে— যোগেন্দ্র । কিংবা যদি একটা চিঠি লেখে, তাহা হইলে আরো ভালো হয় । তোমাকে এই ভার লইতেই হইবে । কিন্তু আর দেরি করিলে চলিবে না। অক্ষয় কহিল, “দেখি, কতদূর কী করিতে পারি।”