পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি ミ○○ রমেশ অস্থির হইয়া উঠিল। কহিল, "না, সে হইতেই পারে না।" কমলা আশ্চর্য হইয়া কহিল, "কেন, হইবে না কেন ?” রমেশ কহিল, “না না, সে কি হয় !" কমলা কহিল, “খুব হইবে- আমি সব ঠিক করিয়া লইতেছি। উমেশা, তুই কিসে খাইবি ?" ጝፃ 「エ রমেশ কহিল, “তুমি যদি ঐ সরাতেই খাইবে তো আমাকে দাও, আমি ভালো করিয়া ধুইয়া আনিতেছি ।” কমলা কেবল সংক্ষেপে কহিল, "পাগল হইয়াছ !" ক্ষণকাল পরে সে বলিয়া উঠিল, “কিন্তু পান। তৈরি করিতে পারি নাই, তুমি আমাকে পান আনাইয়া দাও নাই ।” রমেশ কহিল, “নীচে পানওয়ালা পান বেচিতেছে।” এমনি করিয়া অতি সহজেই ঘরকন্না শুরু হইল। রমেশ মনে মনে উদবিগ্ন হইয়া উঠিল। সে ভাবিতে লাগিল— দাম্পত্যের ভাবকে কেমন করিয়া ঠেকাইয়া রাখা যায় । গৃহিণীর পদ অধিকার করিয়া লইবার জন্য কমলা বাহিরের কোনো সহায়তা বা শিক্ষার প্রত্যাশা রাখে না । সে যতদিন তাহার মামার বাড়িতে ছিল, রাধিয়াছে-বাড়িয়ছে, ছেলে মানুষ করিয়াছে, ঘরের কাজ চালাইয়াছে। তাহার নৈপুণ্য, তৎপরতা ও কর্মের আনন্দ দেখিয়া রমেশের ভারি সুন্দর লাগিল ; কিন্তু সেইসঙ্গে এ কথাও সে ভাবিতে লাগল, “ভবিষ্যতে ইহাকে লইয়া কী ভাবে চলা যাইবে ? ইহাকে কেমন করিয়া কাছে রাখিব, অথচ দূরে রাখিয়া দিব ? দুই জনের মাঝখানে গণ্ডির রেখাটা কোনখানে টানা উচিত ? উভয়ের মধ্যে যদি হেমনলিনী থাকিত তাহা হইলে সমস্তই সুন্দর হইয়া উঠিত । কিন্তু সে আশা যদি ত্যাগ করিতেই হয়, তবে একলা কমলাকে লইয়া সমস্ত সমস্যার মীমাংস যে কী করিয়া হইতে পারে তােহা ভাবিয়া পাওয়া কঠিন । রমেশ স্থির করিল- আসল কথাটা কমলাকে খুলিয়া বলাই উচিত, ইহার পর আর চাপিয়া রাখা চলে না । NR 8 তখনো বেলা যায় নাই, এমন সময় স্টীমার চরে ঠেকিয়া গেল । সেদিন অনেক ঠেলা ঠেলিতেও স্টীমার ভাসিল না। উচু পাড়ের নীচে জলচর পাখিদের পদাঙ্কাখচিত এক স্তর বালুকাময় নিম্নতট কিছু দূর হইতে বিস্তীর্ণ হইয়া নদীতে আসিয়া নামিয়াছে | সেইখানে গ্রামবধুরা তখন দিনান্তের শেষ জলসিঞ্চয় করিয়া লইবার জন্য ঘট লইয়া আসিয়াছিল । তাহদের মধ্যে কোনো কোনো প্ৰগলভা। বিনা অবগুণ্ঠনে এবং কোনো কোনো ভীরু ঘোমটার অন্তরাল হইতে স্টীমারের দিকে চাহিয়া কৌতুহল মিটাইতেছিল। উর্ধর্বনাসিক স্পর্ধিত জলযানটার দুর্বিপাকে গ্রামের ছেলেগুলা পাড়ের উপরে দাড়াইয়া ও পারের জনশূন্য চরের মধ্যে সূর্য অস্ত গৈল । রমেশ জাহাজের রেলিং ধরিয়া সন্ধার আভায় দীপ্যমান পশ্চিম দিগন্তের দিকে চুপ করিয়া চাহিয়া ছিল । কমলা তাহার বেড়া-দেওয়া রাধিবার জায়গা হইতে আসিয়া কামরার দরজার পাশে দাড়াইল । রমেশ শীঘ্ৰ পশ্চাতে মুখ ফিরাইবে এমন সম্ভাবনা না দেখিয়া সে মৃদুভাবে একটু-আধটু কাশিল, তাহাতেও কোনো ফল হইল না ; অবশেষে তাহার চাবির • গোছা দিয়া দরজায় ঠক ঠক করিতে লাগিল। শব্দ যখন প্রবলতর হইল। তখন রমেশ মুখ ফিরাইল । কমলাকে দেখিয়া তাহার কাছে আসিয়া কহিল, “এ তোমার কিরকম ডাকিবার প্রণালী ?” রমেশ কহিল, “কেন, বাপ-মায়ে আমার নামকরণ করিয়াছিলেন কিসের জন্য, যদি কোনো ব্যবহারেই না লাগিবে ? প্রয়োজনের সময় আমাকে রমেশবাবু বলিয়া ডাকিলে ক্ষতি কী ?”