পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SVbt রবীন্দ্র-রচনাবলী “হাঁ বলিয়া এ প্রশ্নের উত্তর দিতে রমেশের মুহুর্তকালের জন্য খটকা বাধিল । তাহাকে নীরব দেখিয়া চক্রবর্তী কহিলেন, “আমাকে মাপ করবেন— পরিবার সঙ্গে আছেন, সে খবরটা আমি বিশ্বস্তসূত্রে পূর্বেই জানিয়াছি। বউমা ঐ ঘরটাতে রাধিতেছেন, আমিও পেটের দায়ে রান্নাঘরের সন্ধানে সেইখানে গিয়া উপস্থিত । বউমাকে বলিলাম, মা, আমাকে দেখিয়া সংকোচ করিয়ো না, আমি পশ্চিম-মুলুকের একমাত্র চক্রবর্তী-খুড়ো।’ আহা, মা যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণ ! আমি আবার কহিলাম, “মা, রান্নাঘরটি যখন দখল করিয়াছ তখন অন্ন হইতে বঞ্চিত করিলে চলিবে না, আমি নিরুপায় ।’’ মা একটুখানি মধুর হাসিলেন, বুঝিলাম প্রসন্ন হইয়াছেন, আজ আর আমার ভাবনা নাই। পাজিতে শুভক্ষণ দেখিয়া প্ৰতিবারই তো বাহির হই, কিন্তু এমন সৌভাগ্য ফি বারে ঘটে না । আপনি কাজে আছেন, আপনাকে আর বিরক্ত করিব না— যদি অনুমতি করেন তো বউমাকে একটু সাহায্য করি। আমরা উপস্থিত থাকিতে তিনি পদ্মহস্তে বেড়ি ধরিবেন কেন ? না না, আপনি লিখুন, আপনাকে উঠিতে হইবে না- আমি পরিচয় করিয়া লইতে জানি ।” এই বলিয়া চক্রবর্তী-খুড়া বিদায় হইয়া রান্নাঘরের দিকে গেলেন। গিয়াই কহিলেন, “চমৎকার গন্ধ বাহির হইয়াছে, ঘন্টটা যা হইবে তা মুখে তুলিবার পূর্বেই বুঝা যাইতেছে। কিন্তু অম্বলটা আমি রাধিব৷ মা ; পশ্চিমের গরমে যাহারা বাস না করে অম্বলটা তাহারা ঠিক দরদ দিয়া রাধিতে পারে না। তুমি ভাবিতেছ, বুড়াটা বলে কী— তেঁতুল নাই, অম্বল রাধিব কী দিয়া ? কিন্তু আমি উপস্থিত থাকিতে তেঁতুলের ভাবনা তোমাকে ভাবিতে হইবে না। একটু সবুর করো, আমি সমস্ত জোগাড় করিয়া আনিতেছি ।” বলিয়া চক্রবর্তী কাগজে-মোড়া একটা ভীড়ে কাসুন্দি আনিয়া উপস্থিত করিলেন। কহিলেন, “আমি অম্বল যা রাধিব তা আজকের মতো খাইয়া বাকিটা তুলিয়া রাখিতে হইবে, মজিতে ঠিক চার দিন লাগিবে। তার পরে একটুখানি মুখে তুলিয়া দিলেই বুঝিতে পরিবে, চক্রবর্তী-খুড়ো দেমাকও করে বটে, কিন্তু অম্বলও রাধে । যাও মা, এবার যাও, মুখ-হাত ধুইয়া লও গে। বেলা অনেক হইয়াছে। রান্না বাকি যা আছে আমি শেষ করিয়া দিতেছি। কিছু সংকোচ করিয়ো না, আমার এ-সমস্ত অভ্যাস আছে মা ; আমার পরিবারের শরীর বরাবর কাহিল, তাহারই অরুচি সারাইবার জন্য অম্বল রাধিয়া আমার হাত পাকিয়া গেছে। বুড়ার কথা শুনিয়া হাসিতেছ। কিন্তু ঠাট্টা নয় মা, এ সত্য কথা ।” কমলা হাসিমুখে কহিল, “আমি আপনার কাছ থেকে অম্বল-রাধা শিখিব।” চক্রবর্তী। ওরে বাস রে! বিদ্যা কি এত সহজে দেওয়া যায় ? এক দিনেই শিখাইয়া বিদ্যার গুমর যদি নষ্ট করি তবে বীণাপাণি অপ্ৰসন্ন হইবেন । দু-চার দিন এ বৃদ্ধিকে খোেশামোদ করিতে হইবে। আমাকে কী করিয়া খুশি করিতে হয় সে তোমাকে ভাবিয়া বাহির করিতে হইবে না ; আমি নিজে সমস্ত বিস্তারিত বলিয়া দিব। প্রথম দফায়, আমি পানটা কিছু বেশি খাই, কিন্তু সুপারি গোটা-গোটা থাকিলে চলিবে না। আমাকে বশীভূত করা সহজ ব্যাপার না ; কিন্তু মা'র ঐ হাসি-মুখখানিতে কাজ অনেকটা অগ্রসর হইয়াছে। ওরে, তোর নাম কী রে ?” উমেশ উত্তর দিল না । সে রাগিয়া ছিল ; তাহার মনে হইতেছিল, কমলার স্নেহ-রাজ্যে বৃদ্ধ তাহার শরিক হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কমলা তাহাকে মীেন দেখিয়া কহিল, “ওর নাম উমেশ ।” বৃদ্ধ কহিলেন, “এ ছোকরাটি বেশ ভালো। এক দমে ইহার মন পাওয়া যায় না। তাহা স্পষ্ট দেখিতেছি, কিন্তু দেখো মা, এর সঙ্গে আমার বনিবে । কিন্তু আর বেলা করিয়ো না, আমার রান্না হইতে কিছুমাত্র বিলম্ব হইবে না।” কমলা যে একটা শূন্যতা অনুভব করিতেছিল। এই বৃদ্ধকে পাইয়া তাহা ভুলিয়া গেল। রমেশও এই বৃদ্ধের আগমনে এখনকার মতো কতকটা নিশ্চিন্ত হইল। প্রথম কয় মাস যখন রমেশ কমলাকে আপনার স্ত্রী বলিয়াই জানিত তখন তাহার আচরণ, তখন পরস্পরের বাধাবিহীন নিকটবর্তিতা, এখনকার হইতে এতই তফাত যে, এই হঠাৎ-প্ৰভেদ বালিকার মনকে আঘাত না করিয়া থাকিতে পারে না। এমন সময়ে এই চক্রবতী আসিয়া রমেশের দিক হইতে কমলার চিন্তাকে যদি