পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডুবি ७७१ 8V এখন রমেশের সম্মুখে কোনো কাজ রহিল না। তাহার মুনে হইতে লাগিল, ইহজীবনে সে যেন কোনো কাজ করিবে না, কোথাও স্থায়ী হইয়া বসিতে পারিবে না। হেমনলিনীর কথা তাহার মনে একেবারেই যে উঠে নাই তাঁহা নহে, কিন্তু তাহা সে সরাইয়া দিয়াছে ; সে মনে মনে বলিয়াছে, “আমার জীবনে যে নিদারুণ ঘটনা আঘাত করিল তাঁহাতে আমাকে চিরদিনের জন্য সংসারের অযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। বাজাহত গাছ প্রফুল্ল উপবনের মধ্যে স্থান পাইবার আশা কেন করিবে ? রমেশ ভ্ৰমণ করিয়া বেড়াইবার জন্য বাহির হইল। এক জায়গায় কোথাও বেশি দিন রহিল না। সে নৌকায় চড়িয়া কাশীর ঘাটের শোভা দেখিল, সে দিল্লিতে কুতবমিনারের উপরে চড়িল, আগ্ৰায় জোৎস্না-রাত্রে তাজ দেখিয়া আসিল । অমৃতসরে গুরুন্দরবার দেখিয়া রাজপুতানায় আবুপর্বতশিখরে মন্দির দেখিতে গেল— এমনি করিয়া রমেশ নিজের শরীর-মনকে আর বিশ্রাম দিল না। অবশেষে এই ভ্ৰমণশ্রান্ত যুবকটির অন্তঃকরণ কেবল ঘর চাহিয়া হা হা করিতে লাগিল । তাহার মনে একটি শান্তিময় ঘরের অতীত স্মৃতি ও একটি সম্ভবপর ঘরের সুখময় কল্পনা কেবলই আঘাত দিতেছে। অবশেষে একদিন তাহার শোককাল-যাপনের ভ্ৰমণ হঠাৎ শেষ হইয়া গেল এবং সে একটা মস্ত কলিকাতায় পৌঁছিয়া রমেশ সেই কলুটােলার গলিটার ভিতরে হঠাৎ প্রবেশ করিতে পারিল না। সেখানে গিয়া সে কী দেখিবে, কী শুনিবে, তাহার কিছুই ঠিকানা নাই। মনের মধ্যে কেবলই একটা আশঙ্কা হইতে লাগিল যে, সেখানে একটা গুরুতর পরিবর্তন হইয়াছে। একদিন তো সে গলির মোড় পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া আসিল। পরদিন সন্ধ্যাবেল রমেশ নিজেকে জোর করিয়া সেই বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত করিল। দেখিল, বাড়ির সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ, ভিতরে কোনো লোক আছে এমন লক্ষণ নাই। তবু সেই সুখন-বেহারটা হয়তো শূন্য বাড়ি আগলাইতেছে মনে করিয়া রমেশ বেহারাকে ডাকিয়া দ্বারে বারিকতক আঘাত করিল। কেহ সাড়া দিল না। প্রতিবেশী চন্দ্রমোহন তাহার ঘরের বাহিরে বসিয়া তামাক খাইতেছিল ; সে কহিল, “কে ও । রমেশবাবু নাকি | ভালো আছেন তো ? এ বাড়িতে অন্নদাবাবুরা তো এখন কেহ নাই ।” রমেশ । তাহারা কোথায় গেছেন জানেন ? চন্দ্র । সে খবর তো বলিতে পারি না, পশ্চিমে গেছেন এই জানি । রমেশ | কে কে গেছেন মশায় ? চন্দ্র। অন্নদাবাবু আর তার মেয়ে । রমেশ । ঠিক জানেন, তাহদের সঙ্গে আর কেহ যান নাই ? চন্দ্র । ঠিক জানি বৈকি । যাইবার সময়ও আমার সঙ্গে দেখা হইয়াছে। তখন রমেশ ধৈর্যরক্ষায় অক্ষম হইয়া কহিল, “আমি একজনের কাছে খবর পাইয়াছি, নলিনবাবু বলিয়া একটি বাবু তাঁহাদের সঙ্গে গেছেন।” চন্দ্র। ভুল খবর পাইয়াছেন। নলিনবাবু আপনার ঐ বাসাটাতেই দিন-কয়েক ছিলেন। ইহারা যাত্রা রবার দিন-দুইচার পূর্বেই তিনি কাশীতে গেছেন। রমেশ তখন এই নলিনবাবুটির বিবরণ প্রশ্ন করিয়া করিয়া চন্দ্রমোহনের কাছ হইতে বাহির করিল। ইরি নাম নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়। শোনা গেছে, পূর্বে রংপুরে ডাক্তারি করিতেন, এখন মাকে লইয়া শীতেই আছেন। রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। জিজ্ঞাসা করিল, “যোগেন এখন কোথায় আছে পারেন ?” চন্দ্রমোহন খবর দিল, যোগেন্দ্র ময়মনসিঙের একটি জমিদারের স্থাপিত হাই-স্কুলের হিউমাস্টার-পদে নিযুক্ত হইয়া বিশাইপুরে গিয়াছে। চন্দ্রমোহন জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবু, আপনাকে তো অনেকদিন দেখি নাই ; আপনি এতকাল কোথায় ছিলেন ?”