পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নীেকাডবি VV), অন্নদাবাবু সুবাধ্য বালকের মতো হেমনলিনীর আদেশ পালন করিতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনোমতেই মনোনিবেশ করিতে পারিলেন না। হেমনলিনীর জন্য র্তাহার মন উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে এক সময় কাগজ রাখিয়া হেমের খোজ করিতে গেলেন ; দেখিলেন, সেই প্রাতে অসময়ে তাহার ঘরের দরজা বন্ধ । কিছু না বলিয়া অন্নদাবাবু বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে আবার একবার হেমনলিনীকে খুজিতে গিয়া দেখিলেন, তখনো তাহার দরজা বন্ধ রহিয়াছে। তখন শ্ৰান্ত অন্নদাবাবু ধাপ করিয়া তাহার চৌকিটার উপর বসিয়া পড়িয়া মুহুর্মুহু মাথার চুলগুলাকে করসঞ্চালনীদ্বারা উচ্ছঙ্খল করিয়া তুলিতে লাগিলেন। নলিনাক্ষ আসিয়া অন্নদাবাবুকে পরীক্ষা করিয়া দেখিল এবং যথাকর্তব্য বলিয়া দিল এবং হেমকে জিজ্ঞাসা করিল, “অন্নদাবাবুর মনে কি বিশেষ কোনো উদবেগ আছে ?” হেম কহিল, “তা থাকিতে পারে।” নলিনাক্ষ কহিল, “যদি সম্ভব হয়, উহার মনের সম্পূর্ণ বিশ্রাম আবশ্যক। আমার মা'র সম্বন্ধেও ঐ এক মুশকিলে পড়িয়াছি ; তিনি একটুতেই এমনি ব্যস্ত হইয়া পড়েন যে, তাহার শরীর সুস্থ রাখা শক্ত হইয়া পড়িয়াছে। সামান্য কী-একটা চিন্তা লইয়া কাল বােধ হয় সমস্তরাত্রি তিনি ঘুমাইতে পারেন নাই। আমি চেষ্টা করি যাহাতে তিনি কিছুমাত্র বিচলিত না হন, কিন্তু সংসারে থাকিতে গেলে তাহা কোনোমতেই সম্ভবপর হয় না ।” হেমনলিনী কহিল, “আপনাকেও আজ তেমন ভালো দেখাইতেছে না ।” নলিনাক্ষ । না, আমি বেশ ভালোই আছি । মন্দ থাকা আমার অভ্যাস নয় । তবে কাল বোধ হয় কিছু রাত জাগিতে হইয়াছিল বলিয়া আজ আমাকে তেমন তাজা দেখাইতেছে না। হেমনলিনী । আপনার মাকে সেবা করিবার জন্য সর্বদা যদি একটি স্ত্রীলোক তাহার কাছে থাকিত, তবে বোধ হয় ভালো হইত। আপনি একলা, আপনার কাজকর্ম আছে, কী করিয়া আপনি উহার শুশ্রুষা করিয়া উঠিবেন ? এ কথাটা হেমনলিনী সহজ ভাবেই বলিয়াছিল, কথাটা সংগীত, সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নাই । কিন্তু বলার পরেই হঠাৎ তাহাকে লজ্জা আক্রমণ করিল, তাহার মুখ আরক্তিম হইয়া উঠিল। তাহার সহসা মনে হইল, নলিনাক্ষবাবু যদি কিছু মনে করেন। অকস্মাৎ হেমনলিনীর এই লজ্জার আবির্ভাব দেখিয়া নলিনাক্ষও তাহার মা'র প্রস্তাবের কথা মনে না করিয়া থাকিতে পারিল না । হেমনলিনী তাড়াতাড়ি সারিয়া লইয়া কহিল, “উহার কাছে একজন ঝি রাখিলে ভালো হয় না ?” নলিনাক্ষ কহিল, “অনেকবার চেষ্টা করিয়াছি, মা কিছুতেই রাজি হন না। তিনি শুদ্ধাচার সম্বন্ধে অত্যন্ত সতর্ক বলিয়া মাহিনা-করা লোকের কাজে তাহার শ্রদ্ধা হয় না। তা ছাড়া, তাহার স্বভাব এমন যে, কেহ যে দায়ে পড়িয়া তাহার সেবা করিতেছে। ইহা তিনি সহ্য করিতে পারেন না।” ইহার পরে এ সম্বন্ধে হেমনলিনীর আর কোনাে কথা চলিল না। সে একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “আপনার উপদেশমতে চলিতে চলিতে মাঝে মাঝে এক-একবার বাধা আসিয়া উপস্থিত হয়, আবার আমি পিছাইয়া পড়ি । আমার ভয় হয়, আমার যেন কোনো আশা নাই। আমার কি কোনোদিন মনের একটা স্থিতি হইবে না, আমাকে কি কেবলই বাহিরের আঘাতে অস্থির হইয়া বেড়াইতে হইবে ?” হেমনলিনীর এই কাতর আবেদনে নলিনাক্ষ একটু চিন্তিত হইয়া কহিল, “দেখুন, বিঘ্ন আমাদের হৃদয়ের সমস্ত শক্তিকে জাগ্ৰত করিয়া দিবার জন্যই উপস্থিত হয়। আপনি হতাশ হইবেন না।” হেমনলিনী কহিল, “কাল সকালে আপনি একবার আসিতে পরিবেন ? আপনার সহায়তা পাইলে আমি অনেকটা বলা লাভ করি।” নলিনাক্ষের মুখে এবং কণ্ঠস্বরে যে-একটি অবিচলিত শান্তির ভাব আছে তাহাতে হেমনলিনী যেন একটা আশ্রয় পায় । নলিনাক্ষ চলিয়া গেল, কিন্তু হেমনলিনীর মনের মধ্যে একটা সত্ত্বনার স্পর্শ রাখিয়া গেল। সে তাহার শয়নগৃহের সম্মুখের বারান্দায় দাড়াইয়া একবার শীতরৌদ্রালোকিত বাহিরের