পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডবি V8S জড়িত হইতে দিব। বাবা, আমি বেশ আছি, আমার জন্য বৃথা উদবিগ্ন হইয়া আমাকে লজ্জা দিয়াে 可s” অন্নদাবাবু কহিলেন, “মা হেম, আমার বয়স হইয়াছে, এখন তোমার একটা স্থিতি না করিয়া তো র মন স্থির হইতে পারে না । তোমাকে এমন তপস্বিনীর মতো কি আমি রাখিয়া যাইতে পারি ?” হেমনলিনী চুপ করিয়া রহিল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “দেখাে মা, পৃথিবীতে একটা আশা চূৰ্ণ হইল বলিয়াই যে আর-সমস্ত দুর্মুল্য জিনিসকে অগ্রাহ্য করিতে হইবে, এমন কোনো কথা নাই। তোমার জীবন কিসে সুখী হইবে, সার্থক হইবে, আজ হয়তো মনের ক্ষোভে তাহা তুমি না জানিতেও পাের, কিন্তু আমি নিয়ত তোমার মঙ্গলচিন্তা করি— আমি জানি তোমার কিসে সুখ, কিসে মঙ্গল- আমার প্রস্তাবটাকে একেবারে উপেক্ষা করিয়ো না।” হেমনলিনী দুই চােখ ছলছল করিয়া বলিয়া উঠিল, “অমন কথা বলিয়ে না, আমি তোমার কোনো কথাই উপেক্ষা করি না। তুমি যাহা আদেশ করবে। আমি নিশ্চয় তাহা পালন করিব, কেবল একবার অন্তঃকরণটা পরিষ্কার করিয়া একবার ভালোরকম করিয়া প্ৰস্তুত হইয়া লইতে চাই ।” অন্নদাবাবু সেই অন্ধকারে একবার হেমনলিনীর অশ্রুসিক্ত মুখে হাত বুলাইয়া তাহার মস্তক স্পর্শ করিলেন। আর কোনো কথা কহিলেন না । পরদিন সকালে যখন অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে লইয়া বাহিরে গাছের তলায় চা খাইতে বসিয়াছেন, তখন অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত হইল। অন্নদাবাবু নীরব প্রশ্নের সহিত তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। অক্ষয় কহিল, “এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না৷ ” এই বলিয়া এক পেয়ালা চা লইয়া সে সেখানে বসিয়া গেল । আস্তে আস্তে কথা তুলিল, “রমেশবাবু ও কমলার জিনিসপত্র কিছু কিছু চক্রবর্তমহাশয়ের ওখানে রহিয়া গেছে, সেগুলি তিনি কোথায় কাহার কাছে পাঠাইবেন, তাই ভাবিতেছেন। রমেশবাবু নিশ্চয়ই আপনাদের ঠিকানা বাহির করিয়া শীঘ্রই এখানে আসিবেন, তাই আপনাদের এখানে যদি-” অন্নদাবাবু হঠাৎ অত্যন্ত রাগ করিয়া উঠিয়া কহিলেন, “অক্ষয়, তোমার কােণ্ডজ্ঞান কিছুমাত্র নাই। রমেশ আমার এখানেই বা কেন আসিবে, আর তাহার জিনিসপত্র আমিই বা কেন রাখিতে যাইব ?” অক্ষয় কহিল, “যা হােক, অন্যায় করুন। আর ভুল করুন রমেশবাবু এখন নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হইয়াছেন, এ সময়ে কি তঁহাকে সত্ত্বনা দেওয়া তাহার পুরাতন বন্ধুদের কর্তব্য নয় ? তাহাকে কি একেবারেই পরিত্যাগ করিতে হইবে ?” অন্নদাবাবু কহিলেন, “অক্ষয়, তুমি কেবল আমাদের পীড়ন করিবার জন্য এই কথাটা লইয়া বার বার আন্দােলন করিতেছ। আমি তোমাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিতেছি, এ প্রসঙ্গ তুমি আমাদের কাছে কখনোই তুলিয়ে না।” হেমনলিনী স্নিগ্ধস্বরে বলিল, “বাবা, তুমি রাগ করিয়ো না, তোমার অসুখ করিবে— অক্ষয়বাবু যাহা বলিতে চান বলুন-না, তাহাতে দোষ কী।” অক্ষয় কহিল, “না না, আমাকে মাপ করবেন, আমি ঠিক বুঝিতে পারি নাই।” (8 মুকুন্দবাবু সপরিজনে কাশী ত্যাগ করিয়া মিরাটে যাইবেন, স্থির হইয়া গেছে। জিনিসপত্র বাঁধা ইয়াছে, কাল প্ৰভাতেই ছাড়িতে হইবে। কমলা নিতান্ত আশা করিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন একটা-কিছু ঘটনা ঘটবে যাহাতে তাহাদের যাওয়া বন্ধ হইবে। ইহাও সে একান্তমনে আশা করিয়াছিল যে, নলিনাক্ষ ডাক্তার হয়তো, আর দুই-একবার তাহার রোগীকে দেখিতে আসিবেন। কিন্তু দুইয়ের কোনােটাই ঘটিল না। পাছে বামুন-ঠাকরুন যাত্রার উদযােগের গােলেমালে পালাইয়া যাইবার অবকাশ পায়, এই আশঙ্কায়