পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

w9ዒ O রবীন্দ্র-রচনাবলী কমলার ঘরে প্রবেশ করিয়াই হেমনলিনী কমলার গলা ধরিয়া কহিল, “কমলা ৷” কমলা খুব বেশি বিস্মিত না হইয়া কহিল, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে আমার নাম কমলা।” হেমনলিনী কহিল, “একজনের কাছে আমি তোমার জীবনের ঘটনা সব শুনিয়াছি। যেমনি শুনিলাম অমনি তখনই আমার মনে সন্দেহ রহিল না তুমিই কমলা। কেন যে, তা বলিতে পারি না।” কমলা কহিল, “ভাই, আমার নাম যে কেহ জানে সে আমার ইচ্ছা নয় । আমার নিজের নামে একেবারে ধিককার জন্মিয় গেছে।” হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু ঐ নামের জোরেই তো তোমাকে তোমার অধিকার পাইতে হইবে।” কমলা মাথা নাড়িয়া কহিল, “ও আমি বুঝি না। আমার জোর কিছুই নাই, আমার অধিকার কিছুই নাই, আমি জোর খাটাইতেই চাই না ।” হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু তোমার স্বামীকে তোমার পরিচয় হইতে বঞ্চিত করবে। কী বলিয়া । তোমার ভালোমন্দ সবই কি তাহার কাছে নিবেদন করিবে না ? তার কাছে কি কিছু লুকানো চলিবে ?” হঠাৎ কমলার মুখ যেন বিবৰ্ণ হইয়া গেল— সে কোনো উত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া নিরূপায়ভাবে হেমনলিনীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। আস্তে আস্তে কমলা মেজের মাদুরের পরে বসিয়া পড়িল ; কহিল, “ভগবান তো জানেন, আমি কোনো অপরাধ করি নাই, তবে তিনি কেন আমাকে এমন করিয়া লজ্জায় ফেলিবেন ? যে পাপ আমার নয়। তার শাস্তি আমাকে কেন দিবেন ? আমি কেমন করিয়া তার কাছে আমার সব কথা প্ৰকাশ করিব ?” হেমনলিনী কমলার হাত ধরিয়া কহিল, “শান্তি নয় ভাই, তোমার মুক্তি হইবে। যতদিন তুমি তোমার স্বামীর কাছে আপনাকে গোপন করিয়া রাখতেছ। ততদিন তুমি আপনাকে একটা মিথ্যার কমলা কহিল, “আবার পাছে সব হারাই এই ভয় যখন মনে আসে তখন সব বল চলিয়া যায় । কিন্তু তুমি যা বলিতেছ। আমি তা বুঝিয়াছি- অদৃষ্ট যা থাকে তা হােক, কিন্তু তার কাছে আপনাকে লুকানাে আর চলিবে না, তিনি আমার সবই জানিবেন।” এই বলিতে বলিতে সে আপনার দুই হাত দৃঢ়বলে বদ্ধ করিল। হেমনলিনী সকরুণচিত্তে কহিল, “তুমি কি চাও আর-কেহ তোমার কথা তঁহাকে জানায় ?” কমলা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “না না, আর-কাহারও মুখ হইতে তিনি শুনিবেন না- আমার কথা আমিই তাহাকে বলিব- আমি বলিতে পারিব।” হেমনলিনী কহিল, “সেই কথাই ভালো । তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে কি না জানি না । আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, তাহা তোমাদের বলিতে আসিয়াছি।” কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে ?” হেমনলিনী কহিল, “কলিকাতায় । তোমাদের সকালে কাজকর্ম আছে, আমরা আর দেরি করিব না । আমি তবে আসি ভাই ! বোনকে মনে রাখিয়ো ।” কমলা তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “আমাকে চিঠি লিখিবে না ?” হেমনলিনী কহিল, “আচ্ছা, লিখিব।” কমলা কহিল, “কখন কী করিতে হইবে, আমাকে তুমি উপদেশ দিয়া লিখিয়াে— আমি জানি তোমার চিঠি পাইলে আমি বল পাইব ।” হেমনলিনী একটু হাসিয়া কহিল, “আমার চেয়ে ভালো উপদেশ দিবার লোক তুমি পাইবে, সেজন্য কিছুই ভাবিয়ে না।” আজ হেমনলিনীর জন্য কমলা মনের মধ্যে বড়োই একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিল । হেমনলিনীর প্রশান্ত মুখে কী-একটা ভাব ছিল যাহা দেখিয়া কমলার চােখে যেন জল ভরিয়া আসিতে চাহিতেছিল। কিন্তু হেমনলিনীর কেমন-একটা দূরত্ব আছে- তাহাকে কোনো কথা বলা যেন চলে না, তাহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে যেন বাধে । আজ কমলার সকল কথাই হেমনলিনীর কাছে প্ৰকাশ