পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOA SR রবীন্দ্র-রচনাবলী বাহির হইত না, তখন সে একরকম ছিল ভালো। এখন প্রতিদিন কমলা তাহার কাছে ধরা পড়িয়া যাইতেছে। আপনাকে গোপন করিয়া রাখিবার এই তো শান্তি! কমলা ভাবিতে লাগিল, নিশ্চয়ই নলিনাক্ষ মনে মনে বলিতেছেন, “এই হরিদাসী মেয়েটিকে মা কোথা হইতে আনিলেন, এমন নির্লজ্জ তো দেখি নাই ! নলিনাক্ষ যদি এক মুহুৰ্তও এমন কথা মনে করে তবে তো সে অসহ্য । কমলা রাত্রে বিছানায় শুইয়া মনে মনে খুব জোর করিয়া প্রতিজ্ঞা করিল, যেমন করিয়া হউক, কালই আপনার পরিচয় দিতে হইবে, তাহার পরে যাহা হয় তাহা হউক ৷” পরদিন কমলা প্ৰত্যুষে উঠিয়া স্নান করিতে গেল। স্নানের পর প্রতিদিন সে একটি ছোটাে ঘটিতে গঙ্গাজল আনিয়া নলিনাক্ষের উপাসনা-ঘরটি ধুইয়া মার্জনা করিয়া তবে অন্য কাজে মন দিত। আজও সে তার দিবসের প্রথম কাজটি সারিতে গিয়া দেখিল, নলিনাক্ষ আজ সকাল-সকাল তাহার উপাসনা-ঘরে প্রবেশ করিয়াছে- এমন তো কোনোদিন হয় নাই | কমলা তাহার মনের মধ্যে অসমাপ্ত কাজের একটা ভার বহন করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। খানিকটা দূর গিয়া সে হঠাৎ থামিল, স্থির হইয়া দাড়াইয়া কী-একটা ভাবিল। তার পরে আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া উপাসনা-ঘরের দ্বারের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহাকে যে কিসে আবিষ্ট করিয়া ধরিল তাহা সে জানে না ; সমস্ত জগৎ তাহার কাছে ছায়ার মতো হইয়া আসিল, সময় যে কতক্ষণ চলিয়া গেল তাহা তাহার বোধ রহিল না। হঠাৎ এক সময় দেখিল, নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কমলা মুহুর্তের মধ্যে উঠিয়া দাড়াইয়া তখনই ভূতলে হাঁটু গাড়িয়া একেবারে নলিনাক্ষের পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্ৰণাম করিল— তাহার সদ্যস্নানে আর্দ্র চুলগুলি নলিনের পা ঢাকিয়া মাটিতে ছড়াইয়া পড়িল। কমলা প্ৰণাম করিয়া উঠিয়া পাথরের মূর্তির মতো স্থির হইয়া দাড়াইল ; তাহার মনে রহিল না যে, তাহার মাথার উপর হইতে কাপড় পড়িয়া গেছে- সে যেন দেখিতেই পাইল না, নলিনাক্ষ অনিমেষ স্থিরদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে- তাহার বাহাজ্ঞান লুপ্ত, সে একটি অন্তরের চৈতন্য-আভায় অপূৰ্বরূপে দীপ্ত হইয়া অবিচলিতকণ্ঠে কহিল, “আমি কমলা।” এই কথাটি বলিবার পরেই তাহার। আপনার কণ্ঠস্বরে তাহার যেন ধ্যানভঙ্গ হইয়া গেল, তাহার একাগ্ৰ চেতনা বাহিরে ব্যাপ্ত হইল। তখন তাহার সর্বাঙ্গ। কঁাপিতে লাগিল ; মাথা নত হইয়া গেল ; সেখান হইতে নড়িবারও শক্তি রহিল না, দাড়াইয়া থাকাও যেন অসাধ্য হইয়া উঠিল ; সে তাহার সমস্ত বল, সমস্ত পণ “আমি, কমলা’ এই একটি কথায় নলিনাক্ষের পায়ের কাছে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছে’- নিজের কাছে নিজের লজ্জা রক্ষা করিবার কোনো উপায় সে আর হাতে রাখে নাই, এখন সমস্তই নলিনাক্ষের দয়ার উপরে নির্ভর । নলিনাক্ষ আস্তে আস্তে তাহার হাতটি আপনার হাতের উপর তুলিয়া লইয়া কহিল, “আমি জানি, তুমি আমার কমলা | এসো, আমার ঘরে এসো ।” উপাসনা-ঘরে তাহাকে লইয়া গিয়া তাহার গলায় কমলার গাথা সেই মালাটি পরাইয়া দিল এবং কহিল, “এসো, আমরা তাহাকে প্ৰণাম করি ।” দুই জনে পাশাপাশি যখন সেই শ্বেতপাথরের মেজের উপরে নত হইল, জানলা হইতে প্ৰভাতের রৌদ্র দুই জনের মাথার উপরে আসিয়া পড়িল । প্ৰণাম করিয়া উঠিয়া আর-একবার নলিনাক্ষের পায়ের ধূলা লইয়া যখন কমলা দাড়াইল তখন তাহার দুঃসহ লজ্জা আর তাহাকে পীড়ন করিল না। হর্ষের উল্লাস নহে। কিন্তু একটি বৃহৎ মুক্তির আচঞ্চল শান্তি তাহার অস্তিত্বকে প্ৰভাতের অকুষ্ঠিত উদারনির্মল আলোকের সহিত ব্যাপ্ত করিয়া দিল । একটি গভীর ভক্তি তাহার হৃদয়ের কানায় কানায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, তাহার অন্তরের পূজা সমস্ত বিশ্বকে ধূপের পূণ্য গন্ধে বেষ্টন করিল। দেখিতে দেখিতে কখন অজ্ঞাতসারে তাহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল ; বড়ো বড়ো জলের ফোটা তাহার দুই কপোল দিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, আর থামিতে চাহিল না, তাহার অনাথ জীবনের সমস্ত দুঃখের মেঘ আজি আনন্দের জলে ঝরিয়া পড়িল । নলিনাক্ষ তাহাকে আর-কোনো কথা না বলিয়া একবার কেবল দক্ষিণ হন্তে তাহার ললাট হইতে সিক্ত