পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8o NR রবীন্দ্র-রচনাবলী সুচরিতা বিনয়কে সম্বোধন করিয়া কোনো কথা কহিবে বিনয় তাহা প্রত্যাশাই করে নাই। সে কুষ্ঠিত হইয়া ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, আমার কোনো কাজ ছিল না, অসুবিধে কিছুই হয় নি।” সতীশ সুচরিতার কাপড় ধরিয়া টানিয়া কহিল, “দিদি, চাবিটা দাও-না। আমাদের সেই আগিনটা এনে বিনয়বাবুকে দেখাই ।” সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “এই বুঝি শুরু হল ! যার সঙ্গে ব্যক্তিয়ারের ভাব হবে তার আর রক্ষে নেই-আগিন তো তাকে শুনতেই হবে, আরো অনেক দুঃখ তার কপালে আছে। বিনয়বাবু, আপনার এই বন্ধুটি ছোটাে, কিন্তু এর বন্ধুত্বের দায় বড়ো বেশি।— সহ্য করতে পারবেন কি না জানি নে ৷” বিনয় সুচরিতার এইরূপ অকুষ্ঠিত আলাপে কেমন করিয়া বেশ সহজে যোগ দিবে কোনােমতেই ভাবিয়া পাইল না। লজ্জা করিবে না দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিয়াও কোনোপ্রকারে ভাঙাচোরা করিয়া একটা জবাব দিল, “না, কিছুই না- আপনি সে— আমি— আমার ও বেশ ভালোই লাগে।” সতীশ তাহার দিদির কােছ হইতে চাবি আদায় করিয়া আগিন আনিয়া উপস্থিত করিল। একটা চোকা কাচের আবরণের মধ্যে তরঙ্গিত সমুদ্রের অনুকরণে নীল-রঙ করা কাপড়ের উপর একটা খেলার জাহাজ রহিয়াছে। সতীশ চাবি দিয়া দাম লগাইতে আগিনের সুরে-তালে জাহাজটা দুলিতে লাগিল এবং সতীশ একবার জাহাজের দিকে ও একবার বিনয়ের মুখের দিকে চাহিয়া মনের অস্থিরতা সংবরণ করিতে পারিল না । এমনি করিয়া সতীশ মাঝখানে থাকাতে অল্প অল্প করিয়া বিনয়ের সংকোচ ভাঙিয়া গেল, এবং ক্রমে সুচরিতার সঙ্গে মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া কথা কহাও তাহার পক্ষে অসম্ভব হইল না। সতীশ অপ্রাসঙ্গিক হঠাৎ এক সময় বলিয়া উঠিল, “আপনার বন্ধুকে একদিন আমাদের এখানে उन(द० कीं ?” ইহা হইতে বিনয়ের বন্ধু সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিয়া পড়িল। পরেশবাবুরা নূতন কলিকাতায় আসিয়াছেন, র্তাহারা গোরা সম্বন্ধে কিছুই জানিতেন না। বিনয় তাহার বন্ধুর কথা আলোচনা করিতে করিতে উৎসাহিত হইয়া উঠিল । গোরার যে কিরূপ অসামান্য প্ৰতিভা, তাহার হৃদয় যে কিরূপ প্রশস্ত, তাহার শক্তি যে কিরূপ অটল, তাহা বলিতে গিয়া বিনয় যেন কথা শেষ করিতে পারিল না । গোরা যে একদিন সমস্ত ভারতবর্ষের মাথার উপরে মধ্যাহ্নপূর্যের মতো প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠিবে, বিনয় কহিল, “এ বিষয়ে আমার সন্দেহমাত্ৰ নাই ।” বলিতে বলিতে বিনয়ের মুখে যেন একটা জ্যোতি দেখা দিল, তাহার সমস্ত সংকোচ একেবারে কাটিয়া গেল। এমনকি, গোরার মত সম্বন্ধে পরেশবাবুর সঙ্গে দুই-একটা বাদপ্রতিবাদও হইল। বিনয় বলিল, “গোরা যে হিন্দুসমাজের সমস্তই অসংকোচে গ্ৰহণ করতে পারছে তার কারণ সে খুব একটা বড়ো জায়গা থেকে ভারতবর্ষকে দেখছে। তার কাছে ভারতবর্ষের ছোটাে বড়ো সমস্তই একটা মহৎ ঐক্যের মধ্যে একটা বৃহৎ সংগীতের মধ্যে মিলে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেরকম করে দেখা আমাদের সকলের পক্ষে সম্ভব নয় বলে ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে বিদেশী আদর্শের সঙ্গে মিলিয়ে তার প্রতি কেবলই অবিচার করি।” সুচরিতা কহিল, “আপনি কি বলেন জাতিভেদটা ভালো ?” এমনভাবে কহিল যেন ও-সম্বন্ধে কোনো তর্কই চলিতে পারে না । বিনয় কহিল, “জাতিভেদটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। অর্থাৎ কোথাও ভালো, কোথাও মন্দ। যদি জিজ্ঞাসা করেন, হাত জিনিসটা কি ভালো, আমি বলব সমস্ত শরীরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে ভালো। যদি বলেন, ওড়বার পক্ষে কি ভালো ? আমি বলব, না । তেমনি ডানা জিনিসটাও ধরবার পক্ষে 7tी काश ।' সুচরিতা উত্তেজিত হইয়া কহিল, “আমি ও সমস্ত কথা বুঝতে পারি নে। আমি জিজ্ঞাসা করছি আপনি কি জাতিভেদ মানেন ?” আরাকারও সঙ্গে তর্ক উঠিলে বিনয় জোর করিয়াই বলিত, “হা, মানি।” আজ তাহার তেমন জোর