পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8SG শ্ৰেষ্ঠ হয়ে কারও থেকে পৃথক হব না, এই আমার সকলের চেয়ে বড়ো আকাঙক্ষা- তার পর এক হলে কোন সংস্কার থাকবে, কোন সংস্কার যাবে, তা আমার দেশই জানে এবং দেশের যিনি বিধাতা তিনিই জানেন।” পানুবাবু কহিলেন, “এমন-সকল প্রথা ও সংস্কার আছে যা দেশকে এক হতে দিচ্ছে না।” গোরা কহিল, “যদি এই কথা মনে করেন যে, আগে সেই সমস্ত প্রথা ও সংস্কারকে একে একে উৎপাটিত করে ফেলবেন তার পরে দেশ এক হবে। তবে সমুদ্রকে ছেচে ফেলে সমুদ্র পার হবার চেষ্টা করা হবে। অবজ্ঞা ও অহংকার দূর করে নম্র হয়ে ভালোবেসে নিজেকে অন্তরের সঙ্গে সকলের করুন, সেই ভালোবাসার কাছে সহস্র ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা সহজেই হার মানবে। সকল দেশের সকল সমাজেই ত্রুটি ও অপূর্ণতা আছে কিন্তু দেশের লোক স্বজাতির প্রতি ভালোবাসার টানে যতক্ষণ এক থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিষ কাটিয়ে চলতে পারে। পাঁচবার কারণ হাওয়ার মধ্যেই আছে। কিন্তু বেঁচে থাকলেই সেটা কাটিয়ে চলি, মরে গেলেই পচে উঠি । আমি আপনাকে বলছি সংশোধন করতে যদি আসেন তো আমরা সহ্য করব না, তা আপনারাই হােন বা মিশনারিই হােন।” পানুবাবু কহিলেন, “কোন করবেন না ?” গোৱা কহিল, “করব না। তার কারণ আছে। বাপ-মায়ের সংশোধন সহ্য করা যায় কিন্তু পাহারাওয়ালার সংশোধনে শোধনের চেয়ে অপমান অনেক বেশি ; সেই সংশোধন সহ্য করতে হলে মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়। আগে আত্মীয় হবেন তার পর সংশোধক হবেন— নইলে আপনার মুখের ভালো কথাতেও আমাদের অনিষ্ট হবে।” এমনি করিয়া একটি একটি সমস্ত কথা আগাগোড়া সুচরিতার মনে উঠিতে লাগিল এবং এইসঙ্গে মনের মধ্যে একটা অনিৰ্দেশ্য বেদনাও কেবলই পীড়া দিতে থাকিল। শ্ৰান্ত হইয়া সুচরিতা বিছানায় ফিরিয়া আসিল এবং চােখের উপর করতল চাপিয়া সমস্ত ভাবনাকে ঠেলিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিল। কিন্তু তাহার মুখ ও কান বা ঝা করিতে লাগিল এবং এই সমস্ত আলোচনা ভাঙিয়া-চুরিয়া তাহার মনের মধ্যে কেবলই আনাগোনা করিতে থাকিল। S SR বিনয় ও গোরা পরেশের বাড়ি হইতে রাস্তায় বাহির হইলে বিনয় কহিল, “গোরা, একটু আস্তে আস্তে চলো ভাই— তোমার পা দুটাে আমাদের চেয়ে অনেক বড়ো— ওর চালটা একটু খাটাে না করলে তোমার সঙ্গে যেতে আমরা ইপিয়ে পড়ি ।” গোরা কহিল, “আমি একলাই যেতে চাই, আমার আজ অনেক কথা ভাববার আছে।” বলিয়া তাহার স্বাভাবিক দ্রুতগতিতে সে বেগে চলিয়া গেল । বিনয়ের মনে আঘাত লাগিল। সে আজ গোরার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া তাহার নিয়ম ভঙ্গ করিয়াছে। সে সম্বন্ধে গোরার কাছে তিরস্কার ভোগ করিলে সে খুশি হইত। একটা ঝড় হইয়া গেলেই তাহাদের চিরদিনের বন্ধুত্বের আকাশ হইতে গুমটি কাটিয়া যাইত এবং সে হাঁপ ছাড়িয়া বীচিত। তাহা ছাড়া আর-একটা কথা তাহাকে পীড়া দিতেছিল। আজ হঠাৎ গোরা পরেশের বাড়িতে প্রথম আসিয়াই বিনয়কে সেখানে বন্ধুভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া নিশ্চয়ই মনে করিয়াছে বিনয় এ বাড়িতে সর্বদাই যাতায়াত করে। অবশ্য, যাতায়াত করিলে যে কোনো অপরাধ আছে তাহা নয় ; গোরা যাহাই বলুক পরেশবাবুর সুশিক্ষিত পরিবারের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হইবার সুযোগ পাওয়া বিনয় একটা বিশেষ লাভ বলিয়া গণ্য করিতেছে ; ইহাদের সঙ্গে মেশামোশি করাতে গোরা যদি কোনো দোষ দেখে তবে সেটা তাহার নিতান্ত গোড়ামি ; কিন্তু পূর্বের কথাবার্তায় গোরা নাকি জানিয়াছে যে বিনয় পরেশবাবুর বাড়িতে যাওয়া-আসা করে না, আজ সহসা তাহার মনে হইতে পারে যে, সে কথাটা সত্য নয়। বিশেষত বরদাসুন্দরী তাহাকে বিশেষ করিয়া ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন, সেখানে তাহার মেয়েদের সঙ্গে তাহার আলাপ হইতে লাগিল— গোরার তীক্ষ লক্ষ হইতে ইহা এড়াইয়া যায় নাই । মেয়েদের সঙ্গে এইরূপ মেলামেশায় ও বরদাসুন্দরীর আত্মীয়তায় মনে মনে বিনয় ভারি একটা গীেরব ও আনন্দ অনুভব করিতেছিল- কিন্তু সেইসঙ্গে এই পরিবারে গোরার সঙ্গে তাহার আদরের পার্থক্য