পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8 SA বর্ষারাত্রির স্তব্ধ অন্ধকারকে স্পন্দিত করিয়া মাঝে মাঝে মেঘ ডাকিয়া উঠিল । বিনয়ের মনে অত্যন্ত একটা ভার বোধ হইতে লাগিল । তাহার মনে হইল তাহার জীবন চিরদিন যে পথ বাহিয়া আসিতেছিল আজ তাহা ছাড়িয়া দিয়া আর-একটা নূতন পথ লইয়াছে। এই অন্ধকারের মধ্যে গোরা কোথায় গেল @द९ (ग्न (काँथोश bब्लेिळ । বিচ্ছেদের মুখে প্রেমের বেগ বাড়িয়া উঠে। গোরার প্রতি প্রেম বিনয়ের হৃদয়ে যে কত বৃহৎ এবং কত প্রবল, আজ সেই প্রেমে আঘাত লাগিবার দিনে তাহা বিনয় অনুভব করিল। বাসায় আসিয়া রাত্রির অন্ধকার এবং ঘরের নির্জনতাকে বিনয়ের অত্যন্ত নিবিড় এবং শূন্য বােধ হইতে লাগিল । গোরার বাড়ি যাইবার জন্য একবার সে বাহিরে আসিল ; কিন্তু আজ রাত্রে গোরার সঙ্গে যে তাহার হৃদয়ের মিলন হইতে পরিবে এমন সে আশা করিতে পারিল না ; তাই সে আবার ফিরিয়া গিয়া শ্ৰান্ত হইয়া বিছানার মধ্যে শুইয়া পড়িল । পরের দিন সকালে উঠিয়া তাহার মন হালকা হইয়া গেল। রাত্রে কল্পনায় সে আপনার বেদনাকে অনাবশ্যক অত্যন্ত বাড়াইয়া তুলিয়াছিল— সকালে গোরার সহিত বন্ধুত্ব এবং পরেশের পরিবারের সহিত আলাপ তাহার কাছে একান্ত পরস্পরবিরোধী বলিয়া বোধ হইল না । ব্যাপারখানা এমন কী গুরুতর, এই বলিয়া কাল রাত্রিকার মনঃপীড়ায় আজ বিনয়ের হাসি পাইল । বিনয় কাধে একখানা চাদর লইয়া দ্রুতপদে গোরার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। গোরা তখন তাহার নীচের ঘরে বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিল। বিনয় যখন রাস্তায় তখনই গোরা তাহাকে দেখিতে পাইয়াছিল— কিন্তু আজ বিনয়ের আগমনে খবরের কাগজ হইতে তাহার দৃষ্টি উঠিল না। বিনয় আসিয়াই কোনো কথা না বলিয়া ফস করিয়া গোরার হাত হইতে কাগজখানা কড়িয়া লইল । গোরা কহিল, “বোধ করি তুমি ভুল করেছ— আমি গীেরমোহন— একজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু।” বিনয় কহিল, “ভুল তুমিই হয়তো করছি। আমি হচ্ছি। শ্ৰীযুক্ত বিনয়— উক্ত গৌরমোহনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বন্ধু।” গোরা । কিন্তু গৌরমোহন এতই বেহায়া যে, সে তার কুসংস্কারের জন্য কারও কাছে কোনোদিন লজা বোধ করে না | বিনয়। বিনয়ও ঠিক তদুপ। তবে কিনা সে নিজের সংস্কার নিয়ে তেড়ে অন্যকে আক্রমণ করতে ों कीं । দেখিতে দেখিতে দুই বন্ধুতে তুমুল তর্ক বাধিয়া উঠিল। পাড়াসুদ্ধ লোক বুঝিতে পারিল আজ গোরার সঙ্গে বিনয়ের সাক্ষাৎ ঘটিয়াছে । গোরা কহিল, “তুমি যে পরেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করছ, সে কথা সেদিন আমার কাছে অস্বীকার করার কী দরকার ছিল ?” বিনয়। কোনো দরকার-বশত অস্বীকার করিনি- যাতায়াত করি নে বলেই অস্বীকার করেছিলুম। এতদিন পরে কাল প্রথম তাদের বাড়িতে প্ৰবেশ করেছি। গোরা। আমার সন্দেহ হচ্ছে অভিমন্যুর মতো তুমি প্রবেশ করবার রাস্তাই জান- বেরোবার রাস্তা জানি না | বিনয় । তা হতে পারে— ঐট হয়তো আমার জন্মগত প্রকৃতি । আমি যাকে শ্ৰদ্ধা করি বা ভালোবাসি তাকে আমি ত্যাগ করতে পারি নে। আমার এই স্বভাবের পরিচয় তুমিও পেয়েছ। গোরা । এখন থেকে তা হলে ওখানে যাতায়াত চলতে থাকবে ? বিনয় । একলা আমারই যে চলতে থাকবে এমন কী কথা আছে ? তোমারও তো চলৎশক্তি আছে, তুমি তো স্থাবর পদার্থ নও। গোরা । আমি তো যাই এবং আসি, কিন্তু তোমার যে লক্ষণ দেখলুম তুমি যে একেবারে যাবারই দাখিল । গরম চা কী রকম লাগল ? বিনয় । কিছু কড়া লেগেছিল।