পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8ᏔbᏊ দুর্মুল্যতা স্বীকার করিয়া লয়। এইজন্য হারানবাবু তাহার মহৎসংকল্পের অনুবতী হইয়া যথােচিত পরীক্ষা-দ্বারা সুচরিতাকে পছন্দ করিয়া লইলেই যে সকলেই তাহা মাথা পাতিয়া লইবে, এ সম্বন্ধে হারানবাবুর এবং অন্য কাহারও মনে কোনাে দ্বিধা ছিল না। এমনকি, পরেশবাবুও হারানবাবুর দাবি মনে মনে অগ্রাহ্য করেন নাই। সকলেই হারানবাবুকে ব্ৰাহ্মসমাজের ভাবী অবলম্বনস্বরূপ জ্ঞান করিত, তিনিও বিরুদ্ধ বিচার না করিয়া তাহাতে সায় দিতেন । এজন্য হারানবাবুর মতো লোকের পক্ষে সুচরিতা যথেষ্ট হইবে কি না ইহাই তাহার চিন্তার বিষয় ছিল ; সুচরিতার পক্ষে হারানবাবুকী পর্যন্ত উপাদেয় হইবে তাহা তঁহার মনেও হয় নাই । এই বিবাহপ্রস্তাবে কেহই যেমন সুচরিতার কথাটা ভাবা আবশ্যক বােধ করে নাই, সুচরিতাও তেমনি নিজের কথা ভাবে নাই। ব্ৰাহ্মসমাজের সকল লোকেরই মতো সেও ধরিয়া লইয়াছিল যে হারানবাবু যেদিন বলিবেন, “আমি এই কন্যাকে গ্ৰহণ করিতে প্ৰস্তুত হইয়াছি সেই দিনই সে এই বিবাহরূপ তাহার মহৎকর্তব্য স্বীকার করিয়া লইবে । এই ভাবেই চলিয়া আসিতেছিল। এমন সময় সেদিন গোরাকে উপলক্ষ করিয়া হারানবাবুর সঙ্গে সুচরিতার যে দুই-চারিটি উষ্ণবাক্যের আদানপ্রদান হইয়া গেল তাহার সুর শুনিয়াই পরেশের মনে সংশয় উপস্থিত হইল যে, সুচরিতা হারানবাবুকে হয়তো যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে না— হয়তো উভয়ের স্বভাবের মধ্যে মিল না হইবার কারণ আছে। এইজন্যই বরদাসুন্দরী যখন বিবাহের জন্য তাগিদ। দিতেছিলেন তখন পরেশ তাঁহাতে পূর্বের মতো সায় দিতে পারিলেন না। সেই দিনই বরদাসুন্দরী সুচরিতাকে নিভৃতে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, “তুমি যে তোমার বাবাকে ভাবিয়ে তুলেছি।” শুনিয়া সুচরিতা চমকিয়া উঠিল— সে যে ভুলিয়াও পরেশবাবুর উদবেগের কারণ হইয়া উঠিবে ইহা অপেক্ষা কষ্ট্রের বিষয় তাহার পক্ষে কিছুই হইতে পারে না । সে মুখ বিবৰ্ণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বরদাসুন্দরী। কী জানি বাছা! তীর মনে হয়েছে যে, তুমি পানুবাবুকে পছন্দ কর না। ব্ৰাহ্মসমাজের সকল লোকেই জানে পানুবাবুর সঙ্গে তোমার বিবাহ একরকম স্থির- এ অবস্থায় যদি তুমি সুচরিতা। কই, মা, আমি তো এ সম্বন্ধে কোনো কথাই কাউকে বলি নি ! সুচরিতার আশ্চর্য হইবার কারণ ছিল। সে হারানবাবুর ব্যবহারে বার বার বিরক্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু বিবাহপ্রস্তাবের বিরুদ্ধে সে কোনোদিন মনেও কোনো চিন্তা করে নাই। এই বিবাহে সে সুখী হইবে কি না-হইবে সে তর্কও তাহার মনে কোনোদিন উদিত হয় নাই, কারণ, এ বিবাহ যে সুখদুঃখের দিক দিয়া বিচাৰ্য নহে। ইহাই সে জানিত । তখন তাহার মনে পড়িল সেদিন পরেশবাবুর সামনেই পানুবাবুর প্রতি সে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করিয়াছিল। ইহাতেই তিনি উদবিগ্ন হইয়াছেন মনে করিয়া তাহার হৃদয়ে আঘাত লাগিল। এমন অসংযম তো সে পূর্বে কোনােদিন প্রকাশ করে নাই, পরেও কখনাে করিবে না বলিয়া মনে মনে সংকল্প করিল। এ দিকে হারানবাবুও সেই দিনই অনতিকাল পরেই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। র্তাহার মনও চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। এতদিন তাহার বিশ্বাস ছিল যে সুচরিতা তঁহাকে মনে মনে পূজা করে ; এই পূজার অর্ঘ্য র্তাহার ভাগে আরো সম্পূর্ণতর হইত যদি বৃদ্ধ পরেশবাবুর প্রতি সুচরিতার অন্ধসংস্কারবশত একটি অসংগত ভক্তি না থাকিত। পরেশবাবুর জীবনের নানা অসম্পূর্ণতা দেখাইয়া দিলেও তীহাকে সুচরিতা যেন দেবতা বলিয়াই জ্ঞান করিত । ইহাতে হারানবাবু মনে মনে হাস্যও করিয়াছেন, ক্ষুন্নাও হইয়াছেন, তথাপি তাহার আশা ছিল কালক্রমে উপযুক্ত অবসরে এই অযথা ভক্তিকে যথাপথে একাগ্ৰধারায় প্রবাহিত করিতে পরিবেন। যাহা হউক, হারানবাবু যতদিন নিজেকে সুচরিতার ভক্তির পাত্র বলিয়া জ্ঞান করিতেন। ততদিন তাহার ছোটোখাটো কাজ ও আচরণ লইয়া কেবল সমালোচনা করিয়াছেন এবং তাহাকে সর্বদা উপদেশ দিয়া গড়িয়া তুলিতেই প্ৰবৃত্ত ছিলেন- বিবাহ সম্বন্ধে কোনাে কথা স্পষ্ট করিয়া উত্থাপন করেন নাই।