পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88O রবীন্দ্র-রচনাবলী কথা তোমাকে বলি, তুমি কথাটি না বলে যে অপমান সহ্য করলে আল্লা তোমাকে এজন্য মাপ করবেন | ।।' মুসলমান কহিল, “যে দােষী আল্লা তাকেই শান্তি দেবেন, আমাকে কেন দেবেন ?” গোরা কহিল, “যে অন্যায় সহ্য করে সেও দোষী, কেননা সে জগতে অন্যায়ের সৃষ্টি করে। আমার কথা বুঝবে না, তবু মনে রেখো, ভালোমানুষ ধর্ম নয় ; তাতে দুষ্ট মানুষকে বাড়িয়ে তোলে। তোমাদের মহম্মদ সে কথা বুঝতেন, তাই তিনি ভালোমানুষ সেজে ধর্মপ্রচার করেন নি।” সেখান হইতে গোরাদের বাড়ি নিকট নয় বলিয়া গোরা সেই মুসলমানকে বিনয়ের বাসায় লইয়া গেল। বিনয়ের দেরাজের সামনে দাড়াইয়া বিনয়কে কহিল, “টাকা বের করো ।” বিনয় কহিল, “তুমি ব্যস্ত হচ্ছি কেন, বোসোগে-না, আমি দিচ্ছি।” বলিয়া হঠাৎ চাবি খুজিয়া পাইল না। অধীর গোরা এক টান দিতেই দুর্বল দেরাজ বদ্ধ চাবির বাধা না মানিয়া খুলিয়া গেল । 鸭 দেরাজ খুলিতেই পরেশবাবুর পরিবারের সকলের একত্রে তোলা একটা বড়ো ফোটােগ্রাফ সর্বাগ্রে চােখে পড়িল । এটি বিনয় তাহার বালক বন্ধু সতীশের নিকট হইতে সংগ্ৰহ করিয়াছিল। টাকা সংগ্ৰহ করিয়া গোরা সেই মুসলমানকে বিদায় করিল, কিন্তু ফোটােগ্রাফ সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিল না। গোরাকে এ সম্বন্ধে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিনয়ও কোনাে কথা তুলিতে পারিল না— অথচ দুই-চারিটা কথা হইয়া গেলে বিনয়ের মন সুস্থ হইত। গোরা হঠাৎ বলিল, “চেললুম।” বিনয় কহিল, “বাঃ, তুমি একলা যাবে কি ! মা যে আমাকে তোমাদের ওখানে খেতে বলেছেন। অতএব আমিও ן" দুইজনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল । বাকি পথ গোরা আর কোনো কথা কহিল না | ডেস্কের মধ্যে ঐ ছবিখানি দেখিয়া গোরাকে আবার সহসা স্মরণ করাইয়া দিল যে, বিনয়ের চিত্তের একটা প্ৰধান ধারা এমন একটা পথে চলিয়াছে যে পথের সঙ্গে গোরার জীবনের কোনো সম্পর্ক নাই। ক্রমে বন্ধুত্বের আদিগঙ্গা নিজীব হইয়া ঐ দিকেই মূল ধারাটা বহিতে পারে এ আশঙ্কা অব্যক্তভাবে গােরার হৃদয়ের গভীরতম তলদেশে একটা অনিৰ্দেশ্য ভারের মতো চাপিয়া পড়িল । সমস্ত-চিন্তায় ও কর্মে এতদিন দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ ছিল না— এখন আর তাহা রক্ষা করা কঠিন হইতেছে- বিনয় এক জায়গায় স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতেছে। গোরা যে কোন চুপ করিয়া গেল বিনয় তাহা বুঝিল । কিন্তু এই নীরবতার বেড়া গায়ে পড়িয়া ঠেলিয়া ভাঙিতে তাহার সংকোচ বোধ হইল। গোরার মনটা যে জায়গায় আসিয়া ঠেকিতেছে সেখানে একটা সত্যকার ব্যবধান আছে ইহা বিনয় নিজেও অনুভব করে। বাড়িতে আসিয়া পীে ছিতেই দেখা গেল মহিম পথের দিকে চাহিয়া দ্বারের কাছে দাড়াইয়া আছেন। দুই বন্ধুকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “ব্যাপারখানা কী ! কাল তো তোমাদের সমস্ত রাত না ঘুমিয়েই কেটেছে- আমি ভাবছিলুম দুজনে বুঝি বা ফুটপাথের উপরে কোথাও আরামে ঘুমিয়ে পড়েছি! বেলা তো কম হয় নি । যাও বিনয়, নাইতে যাও ।” বিনয়কে তাগিদ করিয়া নাহিতে পাঠাইয়া মহিম গোরাকে লইয়া পড়িলেন ; কহিলেন, “দেখে গোরা, তোমাকে যে কথাটা বলেছিলুম সেটা একটু বিবেচনা করে দেখো । বিনয়কে যদি তোমার অনাচারী বলে সন্দেহ হয় তা হলে আজকালকার বাজারে হিন্দু পাত্র পাব কোথায় ? শুধু হিন্দুয়ানি হলেও তো চলবে না— লেখাপড়াও তো চাই!! ঐ লেখাপড়াতে হিন্দুয়ানিতে মিললে যে পদার্থটা হয় সেটা আমাদের হিন্দুমতে ঠিক শাস্ত্রীয় জিনিস নয় বটে, কিন্তু মন্দ জিনিসও নয়। যদি তোমার মেয়ে থাকত তা হলে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে তোমার মতের ঠিক মিল হয়ে যেত।” । গোরা কহিল, “তা, বেশ তো- বিনয় বোধ হয় আপত্তি করবে না।” মহিম কহিল, “শোনো একবাৱ ! বিনয়ের আপত্তির জন্য কে ভাবছে। তোমার আপত্তিকেই তো