পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 br " রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্বন্ধে তাহাও সুচরিতা বুঝিয়াছিল। সেইজন্য সুচরিতা আপনি কথা পড়িল, “বিনয়বাবুকে কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে।” ললিত কহিল, “তিনি কিনা কেবলই গীেরবাবুর কথাই বলেন, সেইজন্যে তোমার ভালো লাগে।” সুচরিতা এ কথাটার ভিতরকার ইঙ্গিতটা বুঝিয়াও বুঝিল না। সে একটা সরল ভােব ধারণ করিয়া কহিল, “তা সত্যি, ওঁর মুখ থেকে গীেরবাবুর কথা শুনতে আমার ভারি আনন্দ হয়। আমি যেন তাকে স্পষ্ট দেখতে পাই ।” ললিত কহিল, “আমার তো কিছু ভালো লাগে না— আমার রাগ ধরে ।” ললিতা কহিল, “গোরা, গোরা, গোরা, দিনরাত্রি কেবল গোরা ! ওঁর বন্ধু গোরা হয়তে, খুব মস্ত লোক, বেশ তো, ভালোই তো- কিন্তু উনিও তো মানুষ।” সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “তা তো বটেই, কিন্তু তার ব্যাঘাত কী হয়েছে ?” ললিতা। ওঁর বন্ধু ওঁকে এমনি ঢেকে ফেলেছেন যে উনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না। যেন কঁচপোকায় তেলাপোকাকে ধরেছে- ওরকম অবস্থায় কাচপোকার উপরেও আমার রাগ ধরে, তেলাপোকার উপরেও আমার শ্রদ্ধা হয় না । ললিতার কথার ঝাজ দেখিয়া সুচরিতা কিছু না বলিয়া হাসিতে লাগিল । ললিতা কহিল, “দিদি, তুমি হাসছ, কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, আমাকে যদি কেউ ওরকম করে চাপা দিতে চেষ্টা করত। আমি তাকে একদিনের জন্যেও সহ্য করতে পারতুম না। এই মনে করে, তুমি- লোকে যাই মনে করুক তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রােখ নি— তোমার সেরকম প্রকৃতিই নয়- সেইজন্যেই আমি তোমাকে এত ভালোবাসি। আসল, বাবার কাছে থেকে তোমার ঐ শিক্ষা হয়েছে- তিনি সব লোককেই তার জায়গািটুকু ছেড়ে দেন।” এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতা এবং ললিতা পরেশবাবুর পরম ভক্ত— বাবা বলিতেই তাঁহাদের হৃদয় যেন স্ফীত হইয়া উঠে । সুচরিতা কহিল, “বাবার সঙ্গে কি আর কারও তুলনা হয় ? কিন্তু যাই বল ভাই, বিনয়বাবু ভারি চমৎকার করে বলতে পারেন ।” ললিতা । ওগুলো ঠিক ওঁর মনের কথা নয় বলেই অত চমৎকার করে বলেন । যদি নিজের কথা বলতেন তা হলে বেশ দিব্যি সহজ কথা হত ; মনে হত না যে ভেবে ভেবে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন । চমৎকার কথার চেয়ে সে আমার ঢের ভালো লাগে । সুচরিতা । তা, রাগ করিস কেন ভাই ? গীেরমোহনবাবুর কথাগুলো ওঁর নিজেরই কথা হয়ে (h(շ | ললিতা। তা যদি হয় তো সে ভারি বিশ্ৰী— ঈশ্বর কি বুদ্ধি দিয়েছেন। পরের কথা ব্যাখ্যা করবার আর মুখ দিয়েছেন। পরের কথা চমৎকার করে বলবার জন্যে ? আমন চমৎকার কথায় কাজ নেই। সুচরিতা। কিন্তু এটা তুই বুঝছিস নে কেন যে বিনয়বাবু গীেরমোহনবাবুকে ভালোবাসেন- তীর সঙ্গে ওঁর মনের সত্যিকার মিল আছে। ললিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, না, না, সম্পূর্ণ মিল নেই। গৌরমোহনবাবুকে মেনে চলা ওঁর অভ্যাস হয়ে গেছে- সেটা দাসত্ব, সে ভালোবাসা নয় । অথচ উনি জোর করে। মনে করতে চান যে তার সঙ্গে ওঁর ঠিক এক মত, সেইজন্যেই তার মতগুলিকে উনি অত চেষ্টা করে চমৎকার করে বলে নিজেকে ও অন্যকে ভোলাতে ইচ্ছা করেন । উনি কেবলই নিজের মনের সন্দেহকে বিরোধকে চাপা দিয়ে চলতে চান, পাছে গীেরমোহনবাবুকে না মানতে হয়। তঁকে না মানবার সাহস ওঁর নেই। ভালোবাসা থাকলে মতের সঙ্গে না মিললেও মানা যেতে পারে- অন্ধ না হয়েও নিজেকে ছেড়ে দেওয়া যায়- ওঁর তো তা নয়— উনি গীেরমোহনবাবুকে মানছেন হয়তো ভালোবাসা থেকে, অথচ কিছুতে সেটা স্বীকার করতে পারছেন না। ওঁর কথা শুনলেই সেটা বেশ স্পষ্ট বােঝা যায়। আচ্ছা!