পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৯৬ : রবীন্দ্র-রচনাবলী নিঃশব্দতিমির বেষ্টিত এই আকাশমণ্ডলের মাঝখানটিতে ললিতার এই নিদ্রাটুকু, এই সুডৌল সুন্দর সম্পূর্ণ বিশ্রামটুকু জগতে তেমনি একটিমাত্ৰ ঐশ্বর্যবলিয়া আজ বিনয়ের কাছে প্রতিভাত হইল। আমি জাগিয়া আছি, “আমি জাগিয়া আছি। — এই বাক্য বিনয়ের বিস্ফারিত বক্ষঃকুহর হইতে অভয়শঙ্খধ্বনির মতো উঠিয়া মহাকাশের অনিমেষ জাগ্ৰত পুরুষের নিঃশব্দবাণীর সহিত মিলিত হইল । এই কৃষ্ণপক্ষের রাত্ৰিতে আরো একটা কথা কেবলই বিনয়কে আঘাত করিতেছিল— আজ রাত্রে গোরা জেলখানায় ! আজ পর্যন্ত বিনয় গোরার সকল সুখ-দুঃখেই ভাগ লইয়া আসিয়াছে, এইবার প্রথম তাহার অন্যথা ঘটিল। বিনয় জানিত গোরার মতো মানুষের পক্ষে জেলের শাসন কিছুই নহে, কিন্তু প্ৰথম হইতে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিনয়ের সঙ্গে গোরার কোনো যোগ ছিল না— গোরার জীবনের এই একটা প্রধান ঘটনা একেবারেই বিনয়ের সংস্রব ছাড়া। দুই বন্ধুর জীবনের ধারা এই-যে এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন হইয়াছে— আবার যখন মিলিবে তখন কি এই বিচ্ছেদের শূন্যতা পূরণ হইতে পরিবে ? বন্ধুত্বের সম্পূর্ণতা কি এবার ভঙ্গ হয় নাই ? জীবনের এমন অখণ্ড, এমন দুর্লভ বন্ধুত্ব ! আজি একই রাত্রে বিনয় তাহার এক দিকের শূন্যতা এবং আর-এক দিকের পূর্ণতাকে একসঙ্গে অনুভব করিয়া জীবনের সৃজনপ্রিলয়ের সন্ধিকালে স্তব্ধ হইয়া অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া রহিল। গোরা যে ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছিল। দৈবক্রমেই বিনয় তাহাতে যোগ দিতে পারে নাই অথবা গোরা যে জেলে গিয়াছে দৈবক্রমেই সেই কারাদুঃখের ভাগ লওয়া বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব হইয়াছে, এ কথা যদি সত্য হইত। তবে ইহাতে বন্ধুত্ব ক্ষুন্ন হইতে পারিত না । কিন্তু গোরা ভ্ৰমণে বাহির হইয়াছিল এবং বিনয় অভিনয় করিতেছিল। ইহা আকস্মিক ব্যাপার নহে। বিনয়ের সমস্ত জীবনের ধারা এমন একটা পথে আসিয়া পড়িয়াছে যাহা তাহাদের পূর্ব-বন্ধুত্বের পথ নহে, সেই কারণেই এতদিন পরে এই বাহা বিচ্ছেদও সম্ভবপর হইয়াছে। কিন্তু আজ আর কোনো উপায় নাই- সত্যকে অস্বীকার করা আর চলে না, গোরার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন এক পথ অনন্যমনে আশ্রয় করা বিনয়ের পক্ষে আজ আর সত্য নহে। কিন্তু গোরা ও বিনয়ের চিরজীবনের ভালোবাসা কি এই পথভেদের দ্বারাই ভিন্ন হইবে ? এই সংশয় বিনয়ের হৃদয়ে হৃৎকম্প উপস্থিত করিল। সে জানিত গোরা তাহার সমস্ত বন্ধুত্ব এবং সমস্ত কর্তব্যকে এক লক্ষ্যপথে না। টানিয়া চলিতে পারে না । প্ৰচণ্ড গোরা !! তাহার প্রবল ইচ্ছা ! জীবনের সকল সম্বন্ধের দ্বারা তাহার সেই এক ইচ্ছাকেই মহীয়সী করিয়া সে জয়যাত্রায় চলিবে— বিধাতা গোরার প্রকৃতিতে সেই রাজমহিমা অপণ করিয়াছেন । ঠিক গাড়ি পরেশবাবুর দরজার কাছে আসিয়া দাড়াইল । নামিবার সময় ললিতার যে পা কঁাপিল এবং বাড়িতে প্রবেশ করিবার সময় সে যে জোর করিয়া নিজেকে একটু শক্ত করিয়া লইল তাহা বিনয় স্পষ্ট বুঝিতে পারিল । ললিতা ঝোকের মাথায় এবার যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার অপরাধ যে কতখানি তাহার ওজন সে নিজে কিছুতেই আন্দাজ করিতে পারিতেছিল না। ললিতা জানিত পরেশবাবু তাহাকে এমন কোনো কথাই বলিবেন না যাহাকে ঠিক ভৎসনা বলা যাইতে পারে— কিন্তু সেইজন্যই পরেশবাবুর চুপ করিয়া থাকাকেই সে সব চেয়ে ভয় করিত। ললিতার এই সংকোচের ভাব লক্ষ্য করিয়া বিনয় এরূপ স্থলে তাহার কী কর্তব্য ঠিকটি ভাবিয়া পাইল না । সে সঙ্গে থাকিলে ললিতার সংকোচের কারণ অধিক হইবে কি না তাহাই পরীক্ষা করিবার জন্য সে একটু দ্বিধার স্বরে ললিতাকে কহিল, “তবে এখন যাই।” ললিতা তাড়াতাড়ি কহিল, “না, চলুন, বাবার কাছে চলুন।” ললিতার এই ব্যগ্ৰ অনুরোধে বিনয় মনে মনে আনন্দিত হইয়া উঠিল। বাড়িতে পৌঁছিয়া দিবার পর হইতে তাহার যে কর্তব্য শেষ হইয়া যায় নাই, এই একটা আকস্মিক ব্যাপারে ললিতার সঙ্গে তাহার জীবনের যে একটা বিশেষ গ্রস্থিবিন্ধন হইয়া গেছে- তাহাই মনে করিয়া বিনয় ললিতার পার্থে যেন একটু বিশেষ জোরের সঙ্গে দাড়াইল । তাহার প্রতি ললিতার এই নির্ভর-কল্পনা যেন একটি স্পর্শের মতো তাহার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ সঞ্চার করিতে লাগিল। তাহার মনে হইল ললিতা যেন তাহার ডান