পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা t- QOQ উভয়কেই একই জেলের একই ঘানি টানতে হয়। এরকম যে সম্ভব হয়েছে কোনাে একজন মানুষকে সেজন্য দোষ দেওয়া যায় না। সমস্ত মানুষের পাপ এজন্য দায়ী।” হঠাৎ এই প্রসঙ্গ বন্ধ করিয়া পরেশবাবু জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিলেন, “তুমি কার সঙ্গে এলে ?” ললিতা বিশেষ একটু জোর করিয়া যেন খাড়া হইয়া কহিল, “বিনয়বাবুর সঙ্গে।” বাহিরে যতই জোর দেখাক তাহার ভিতরে দুর্বলতা ছিল। বিনয়বাবুর সঙ্গে আসিয়াছে। এ কথাটা ললিতা বেশ সহজে বলিতে পারিল না— কোথা হইতে একটু লজ্জা আসিয়া পড়িল এবং সে লজ্জা মুখের ভাবে বাহির হইয়া পড়িতেছে মনে করিয়া তাহার লজ্জা আরো বাড়িয়া উঠিল। পরেশবাবু এই খামখেয়ালি দুৰ্জয় মেয়েটিকে তাহার অন্যান্য সকল সস্তানের চেয়ে একটু বিশেষ মোেহই করিতেন । ইহার ব্যবহার অন্যের কাছে নিন্দনীয় ছিল বলিয়াই ললিতার আচরণের মধ্যে যে একটি সত্যপরতা আছে সেইটিকে তিনি বিশেষ করিয়া শ্রদ্ধা করিয়াছেন । তিনি জানিতেন ললিতার যে দোষ সেইটেই বেশি করিয়া লোকের চােখে পড়িবে, কিন্তু ইহার যে গুণ তাহা যতই দুর্লভ হউক-না কেন লোকের কাছে আদর পাইবে না। পরেশবাবু সেই গুণটিকে যত্নপূর্বক সাবধানে আশ্রয় দিয়া করিতে তিনি চান নাই। র্তাহার অন্য দুইটি মেয়েকে দেখিবামাত্রই সকলে সুন্দরী বলিয়া স্বীকার করে ; তাহাদের বর্ণ উজ্জ্বল, তাহদের মুখের গড়নেও খুঁত নাই—কিন্তু ললিতার রঙ তাহাদের চেয়ে কালো, এবং তাহার মুখের কমনীয়তা সম্বন্ধে মতভেদ ঘটে। বরদাসুন্দরী সেইজন্য ললিতার পাত্র জোঁটা লইয়া সর্বদাই স্বামীর নিকট উদবেগ প্রকাশ করিতেন। কিন্তু পরেশবাবু ললিতার মুখে যে-একটি সৌন্দর্য দেখিতেন তাহা রঙের সৌন্দর্য নহে, গড়নের সৌন্দর্য নহে, তাহা অস্তরের গভীর সৌন্দর্য। তাহার মধ্যে কেবল ললিত্য নহে, স্বাতন্ত্র্যের তেজ এবং শক্তির দৃঢ়তা আছে— সেই দৃঢ়তা সকলের মনােরম নহে। তাহা লোকবিশেষকে আকর্ষণ করে, কিন্তু অনেককেই দূরে ঠেলিয়া রাখে। সংসারে ললিতা প্রিয় হইবে না, কিন্তু খাটি হইবে ইহাই জানিয়া পরেশবাবু কেমন একটু বেদনার সহিত ললিতাকে কাছে টানিয়া লাইতেন— তাহাকে আর কেহ ক্ষমা করিতেছে না জানিয়াই তাহাকে করুণার সহিত বিচার করিতেন । যখন পরেশবাবু শুনিলেন ললিত একলা বিনয়ের সঙ্গে হঠাৎ চলিয়া আসিয়াছে, তখন তিনি এক মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন এজন্য ললিতাকে অনেক দিন ধরিয়া অনেক দুঃখ সহিতে হইবে ; সে যেটুকু অপরাধ করিয়াছে লোকে তাহার চেয়ে বড়ো অপরাধের দণ্ড তাহার প্রতি বিধান করিবে । সেই কথাটা তিনিচুপ করিয়া ক্ষণকাল ভাবিতেছেন, এমন সময় ললিতা বলিয়া উঠিল, “বাবা, আমি দোষ করেছি। কিন্তু এবার আমি বেশ বুঝতে পেরেছি যে, ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে আমাদের দেশের লোকের এমন সম্বন্ধ যে তীর আতিথ্যের মধ্যে কিছুই সম্মান নেই, কেবলই অনুগ্রহ মাত্র। সেটা সহ্য করেও কি আমার সেখানে থাকা উচিত ছিল ?” পরেশবাবুর কাছে প্রশ্নটি সহজ বলিয়া বােধ হইল না। তিনি কোনাে উত্তর দিবার চেষ্টা না করিয়া একটু হাসিয়া ললিতার মাথায় দক্ষিণ হস্ত দিয়া মৃদু আঘাত করিয়া বলিলেন, “পাগলী!” । এই ঘটনা সম্বন্ধে চিন্তা করিতে করিতে সেদিন অপরাহুে পরেশবাবু যখন বাড়ির বাহিরে পায়চারি করিতেছিলেন এমন সময় বিনয় আসিয়া তাহাকে প্ৰণাম করিল। পরেশবাবু গোরার কারাদণ্ড সম্বন্ধে প্রসঙ্গই উত্থাপন করিলেন না। অন্ধকার হইয়া আসিলে কহিলেন, “চলো, বিনয়, ঘরে চলো ।” বিনয় কহিল, “না, আমি এখন বাসায় যাব।” পরেশবাবু তাহাকে দ্বিতীয় বার অনুরোধ করিলেন না। বিনয় একবার চকিতের মতো দোতলার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। উপর হইতে ললিতা বিনয়কে দেখিতে পাইয়াছিল। যখন পরেশবাবু একলা ঘরে ঢুকিলেন তখন ললিতা মনে করিল, বিনয় হয়তো আর-একটু পরেই আসিবে। আর-একটু পরেও বিনয় আসিল না। তখন টেবিলের উপরকার দুটাে-একটা বই ও কাগজ-চাপা নাড়াচাড়া করিয়া ললিতা ঘর হইতে চলিয়া