পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(PK (? SVO সুচরিতা কহিত, “আমাকে তুমি জোর করে বিদায় করতে পারবে না মাসি ! আমি তোমাকে কখনো ছাড়ব না— আমি বরাবর তোমার এই কাছেই রইলুম।” । বলিয়া তাহার বুকের মধ্যে মাথা রাখিয়া শিশুর মতো চুপ করিয়া থাকিত । দুই দিনের মধ্যেই সুচরিতার সঙ্গে তাহার মাসির এমন একটা গভীর সম্বন্ধ বাধিয়া গেল যে ক্ষুদ্র কালের দ্বারা তাহার পরিমাপ হইতে পারে না । বরদাসুন্দরী ইহাতেও বিরক্ত হইয়া গেলেন। ‘মেয়েটার রকম দেখো। যেন আমরা কোনোদিন উহার কোনো আদর-যত্ন করি নাই। বলি, এতদিন মাসি ছিলেন কোথায় ! ছােটােবেলা হইতে আমরা যে এত করিয়া মানুষ করিলাম আর আজ মাসি বলিতেই একেবারে অজ্ঞান। আমি কর্তাকে বরাবর বলিয়া আসিয়াছি, ঐ-যে সুচরিতাকে তোমরা সবাই ভালো ভালো কর, ও কেবল বাহিরে ভালোমানুষ করে, কিন্তু উহার মন পাবার জো নাই। আমরা এতদিন উহার যা করিয়াছি সব বৃথাই হইয়াছে।’ পরেশ যে বরদাসুন্দরীর দরদ বুঝিবেন না তাহা তিনি জানিতেন। শুধু তাই নহে, হরিমোহিনীর প্রতি বিরক্তি প্ৰকাশ করিলে তিনি যে পরেশের কাছে খাটাে হইয়া যাইবেন ইহাতেও তাহার সন্দেহ ছিল না। সেইজন্যই তীর রাগ আরো বাড়িয়া উঠিল। পরেশ যাহাই বলুন, কিন্তু অধিকাংশ বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গেই যে বরদাসুন্দরীর মত মেলে ইহাই প্রমাণ করিবার জন্য তিনি দল বাড়াইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন । তাহাদের সমাজের প্রধান-অপ্রধান সকল লোকের কাছেই হরিমোহিনীর ব্যাপার কাছে তাহার কুদৃষ্টান্ত, ইহা লইয়া তাহার। আক্ষেপ-অভিযোগের অন্ত রহিল না। শুধু লোকের কাছে অভিযোগ নহে, বরদাসুন্দরী সকল প্রকারে হরিমোহিনীর অসুবিধা ঘটাইতে লাগিলেন । হরিমোহিনীর রন্ধনাদির জল তুলিয়া দিবার জন্য যে একজন গোয়ালা বেহারা ছিল তাহাকে তিনি ঠিক সময় বুঝিয়া অন্য কাজে নিযুক্ত করিয়া দিতেন । সে সম্বন্ধে কোনো কথা উঠিলে হরিমোহিনী ব্যবহার করিবেন না । সে কথা কেহ বলিলে বলিতেন, “অত বামনাই করতে চান তো আমাদের ব্ৰাহ্মা-বাড়িতে এলেন কেন ? আমাদের এখানে ও-সমস্ত জাতের বিচার করা চলবে না । আমি কোনোমতেই এতে প্রশ্রয় দেব না ।" এইরূপ উপলক্ষে তাহার কর্তব্যবোধ অত্যন্ত উগ্ৰ হইয়া উঠিত । তিনি বলিতেন, ব্ৰাহ্মসমাজে ক্রমে সামাজিক শৈথিল্য অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিতেছে ; এইজন্যই ব্ৰাহ্মসমাজ যথেষ্ট-পরিমাণে কাজ করিতে পারিতেছে না । তাহার সাধ্যমত তিনি এরূপ শৈথিল্যে যোগ দিতে পরিবেন না। না, কিছুতেই না । ইহাতে যদি কেহ তাহাকে ভুল বোঝে। তবে সেও স্বীকার, যদি আত্মায়েরাও বিরুদ্ধ হইয়া উঠে। তবে সেও তিনি মাথা পাতিয়া লইবেন । পৃথিবীতে মহাপুরুষেরা, যাহারা কোনো মহৎ কর্ম করিয়াছেন, তাহাদের সকলকেই যে নিন্দ ও বিরোধ সহ্য করিতে হইয়াছে সেই কথাই তিনি সকলকে স্মরণ করাইতে লাগিলেন । কোনো অসুবিধায় হরিমোহিনীকে পরাস্ত করিতে পারিত না । তিনি কৃচ্ছসাধনের চূড়ান্ত সীমায় উঠিবেন বলিয়াই যেন পণ করিয়াছিলেন। তিনি অন্তরে যে অসহ্য দুঃখ পাইয়াছেন বাহিরেও যেন এইরূপে দুঃখকে নিজের ইচ্ছার দ্বারা বরণ করিয়া তাহাকে আত্মীয় করিয়া লইয়া তাহাকে বশ করিবার এই সাধনা | হরিমোহিনী যখন দেখিলেন। জলের অসুবিধা হইতেছে তখন তিনি রন্ধন একেবারে ছাড়িয়াই দিলেন । তাহার ঠাকুরের কাছে নিবেদন করিয়া প্ৰসাদস্বরূপে দুধ এবং ফল খাইয়া কাটাইতে লাগিলেন । সুচরিতা ইহাতে অত্যন্ত কষ্ট পাইল। মাসি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলিলেন, “মা, এ আমার বড়ো ভালো হয়েছে। এই আমার প্রয়োজন ছিল । এতে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমার আনন্দই হয় ।” সুচরিতা কহিল, “মাসি, আমি যদি অন্য জাতের হাতে জল বা খাবার না খাই তা হলে তুমি আমাকে VIVO8