পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(28Wり রবীন্দ্র-রচনাবলী যে ললিতার পক্ষে অত্যন্ত সত্য পদার্থ, সে তো আধা-আধি কিছুই জানে না, সুখ-দুঃখ তাহার পক্ষে কিছু-সত্য কিছু-ফাকি নহে। ললিতা প্ৰতিদিন নিজের জীবনের মধ্যে ব্যর্থ ধিক্কার বহন করিয়া বাচিয়া থাকিবে কেমন করিয়া ? সে যে সম্মুখে কোথাও একটা প্রতিষ্ঠা, একটা মঙ্গল-পরিণাম দেখিতে পাইতেছে না। এমনভাবে নিরুপায় ভাসিয়া চলিয়া যাওয়া তাহার স্বভাবসিদ্ধ নহে। সেইদিনই মধ্যাহ্নে ললিতা সুচরিতার বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরে গৃহসজ্জা বিশেষ কিছুই নাই। মেঝের উপর একটি ঘর-জোড়া শতরঞ্চ, তাহারই এক দিকে সুচরিতার বিছানা পাতা ও অন্য দিকে হরিমোহিনীর বিছানা । হরিমোহিনী খাটে শোন না বলিয়া সুচরিতাও তাহার সঙ্গে এক ঘরে নীচে বিছানা করিয়া শুইতেছে। দেয়ালে পরেশবাবুর একখানি ছবি টাঙানো | পাশের একটি ছোটাে ঘরে সতীশের খাট পড়িয়াছে এবং এক ধারে একটি ছোটাে টেবিলের উপর দোয়াত কলম খাতা বই স্লেট বিশৃঙ্খলভাবে ছড়ানো রহিয়াছে। সতীশ ইস্কুলে গিয়াছে। বাড়ি নিস্তব্ধ । আহারান্তে হরিমোহিনী তাহার মাদুরের উপর শুইয়া নিদ্রার উপক্ৰম করিতেছেন, এবং সুচরিতা পিঠে মুক্ত চুল মেলিয়া দিয়া শতরাঞ্চে বসিয়া কোলের উপর বালিশ লইয়া একমনে কী পড়িতেছে। সম্মুখে আরো কয়খানা বই পড়িয়া আছে। ললিতাকে হঠাৎ ঘরে ঢুকিতে দেখিয়া সুচরিতা যেন লজিত হইয়া প্রথমটা বই বন্ধ করিল, পরীক্ষণে লজার দ্বারাই লজ্জাকে দমন করিয়া বই যেমন ছিল তেমনি রাখিল । এই বইগুলি গোরার রচনাবলী । হরিমোহিনী উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, “এসো, এসো মা, ললিতা এসো | তোমাদের বাড়ি ছেড়ে সুচরিতার মনের মধ্যে কেমন করছে সে আমি জানি । ওর মন খারাপ হলেই ঐ বইগুলো নিয়ে পড়তে বসে । এখনই আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম তোমরা কেউ এলে ভালো হয়— আমনি তুমি এসে পড়েছ- অনেক দিন বাচাবে মা !” ললিতার মনে যে কথাটা ছিল সুচরিতার কাছে বসিয়া সে একেবারেই তাহা আরম্ভ করিয়া দিল । সে কহিল, “সুচিদিদি, আমাদের পাড়ায় মেয়েদের জন্যে যদি একটা ইস্কুল করা যায় তা হলে কেমন হয় ।” হরমোহিনী অবাক হইয়া কহিলেন, “শোনো একবার কথা ! তোমরা ইস্কুল করবে। কী!" কৃতি কহিল,"ক্ষে করে করা যাবে বল। কে আমাদের সাহায্য করবে ? বাবাকে বলেছিস «و ললিতা কহিল, “আমরা দুজনে তো পড়াতে পারব | হয়তো বড়দিদিও রাজি হবে।” সুচরিতা কহিল, “শুধু পড়ানো নিয়ে তো কথা নয়। কী রকম করে ইস্কুলের কাজ চালাতে হবে তার সব নিয়ম বেঁধে দেওয়া চাই, বাড়ি ঠিক করতে হবে, ছাত্রী সংগ্ৰহ করতে হবে, খরচ জোগাতে হবে। আমরা দুজন মেয়েমানুষ এর কী করতে পারি ” ললিতা কহিল, “দিদি, ও কথা বললে চলবে না। মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই কি নিজের মনখানাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে পড়ে আছাড় খেতে থাকিব ? পৃথিবীর কোনো কাজেই লািগব না ?" | ললিতার কথাটার মধ্যে যে বেদনা ছিল সুচরিতার বুকের মধ্যে গিয়া তাহা বাজিয়া উঠিল। সে কোনো উত্তর না করিয়া ভাবিতে লাগিল । ললিত কহিল, “পাড়ায় তো অনেক মেয়ে আছে। আমরা যদি তাদের অমনি পড়াতে চাই বাপ-মারা তো খুশি হবে । তাদের যে-কজনকে পাই তোমার এই বাড়িতে এনে পড়ালেই হবে। এতে খরচ কিসের ?” এই বাড়িতে রাজ্যের অপরিচিত ঘরের মেয়ে জড়ো করিয়া পড়াইবার প্রস্তাবে হরিমোহিনী উদবিগ্ন হইয়া উঠিলেন। তিনি নিরিবিলি পূজা-অৰ্চনা লইয়া শুদ্ধ শুচি হইয়া থাকিতে চান, তাহার ব্যাঘাতের সম্ভাবনায় আপত্তি করিতে লাগিলেন ।