পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(53. (፩ ዓ S চেয়ে বড়ো হইয়া উঠিয়াছে সেটা আজ কেমন করিয়া যে গোরার কাছে পাড়িবে তাহা সে ভাবিয়াই পাইতেছিল না। পরেশবাবুর বাড়ির লোকদের সম্বন্ধে গোরার মনেও একটা জিজ্ঞাসা জাগিতেছিল, কিন্তু সে কিছুই বলিল না। বিনয় কথাটা পাড়িবে বলিয়া সে অপেক্ষা করিতেছিল। অবশ্য বাড়ির মেয়েরা সকলে কেমন আছেন সে কথা গোরা পরেশবাবুকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কিন্তু সে তো কেবল ভদ্রতার প্রশ্ন । তাহারা সকলে ভালো আছে। এইটুকু খবরের চেয়েও আরো বিস্তারিত বিবরণ জানিবার জন্য তাহার মনের মধ্যে ঔৎসুক্য ছিল। এমন সময় মহিম ঘরের মধ্যে আসিয়া আসন গ্ৰহণ করিয়া সিঁড়ি উঠার শ্রমে কিছুক্ষণ হাঁপাইয়া লাইলেন । তাহার পরে কহিলেন, “বিনয়, এতদিন তো গোরার জন্যে অপেক্ষা করা গেল। এখন আর তো কোনাে কথা নেই। এবার দিন ক্ষণ ঠিক করে ফেলা যাক। কী বল গোরা ? বুঝেছ তো কী কথাটা হচ্ছে ?” গোরা কোনো কথা না বলিয়া একটুখানি হাসিল । মহিম কহিলেন, “হাসছ যে ! তুমি ভাবিছ আজও দাদা সে কথাটা ভোলে নি । কিন্তু কন্যাটি তো । স্বপ্ন নয়, স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। সে একটি সত্য পদার্থ— ভোলবার জো কী ! হাসি নয় গোরা, এবারে যা হয় ঠিক করে ফেলো ।” গোরা কহিল, “ঠিক করবার কর্তা যিনি তিনি তো স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন।” মহিম কহিলেন, “সর্বনাশ ! ওঁর নিজের ঠিক নেই, উনি ঠিক করবেন ! তুমি এসেছ, এখন তোমার উপরেই সমস্ত ভার ” আজ বিনয় গভীর হইয়া চুপ করিয়া রহিল, তাহার স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসের ছােলও সে কোনো কথা বলিবার চেষ্টা করিল না । গোরা বুঝিল, একটা গোল আছে। সে কহিল, “নিমন্ত্রণ করতে যাবার ভার নিতে পারি, মিঠাই ফরমাশ দেবারও ভার নেওয়া যায়, পরিবেশন করতেও রাজি আছি, কিন্তু বিনয় যে তোমার মেয়েকে বিয়ে করবেনই সে ভার আমি নিতে পারব না । যার নির্বন্ধে সংসারে এই-সমস্ত কাজ হয় তার সঙ্গে আমার বিশেষ চেনাশোনা নেই— বরাবর আমি তাকে দূরে থেকেই নমস্কার করেছি।” মহিম কহিলেন, “তুমি দূরে থাকলেই যে তিনিও দূরে থাকেন তা মনেও কোরো না। হঠাৎ কবে চমক লাগাবেন কিছু বলা যায় না। তোমার সম্বন্ধে তীর মতলব কী তা ঠিক বলতে পারছি নে, কিন্তু এর সম্বন্ধে ভারি গোল ঠেকছে। একলা প্রজাপতি ঠাকুরের উপরেই সব বরাত না দিয়ে তুমি যদি নিজেও উদযোগী না হও তা হলে হয়তো অনুতাপ করতে হবে, এ আমি বলে রাখছি।” গোরা কহিল, “ যে ভার আমার নয় সে ভার না নিয়ে অনুতাপ করতে রাজি আছি, কিন্তু নিয়ে অনুতাপ করা আরো শক্ত | সেইটো থেকে রক্ষা পেতে চাই ।” মহিম কহিলেন, “ব্ৰাহ্মণের ছেলে জাত কুল মান সমস্ত খোওয়াবে, আর তুমি বসে থেকে দেখবে ? দেশের লোকের হিন্দুয়ানি রক্ষার জন্যে তোমার আহার নিদ্রা বন্ধ, এ দিকে নিজের পরম বন্ধুই যদি জাত ভাসিয়ে দিয়ে ব্ৰাহ্মর ঘরে বিয়ে করে বসে তা হলে মানুষের কাছে যে মুখ দেখাতে পারবে না । বিনয়, তুমি বোধ হয় রাগ করছ, কিন্তু ঢ়ের লোক তোমার অসাক্ষাতেই এই সব কথা গোরান্সে বলত— তারা বলবার জন্যে ছটফট করছে— আমি সামনেই বলে গেলুম, তাতে সকল পক্ষে ভালোই হবে । গুজবটা যদি মিথ্যাই হয় তা হলে সে কথা বললেই চুকে যাবে, যদি সত্যি হয় তা হলে বোঝাপড়া করে নাও ” মহিম চলিয়া গেলেন, বিনয় তখনো কোনো কথা কহিল না। গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিনয়, ব্যাপারটা কী ?” বিনয় কহিল, “শুধু কেবল গোটাকতক খবর দিয়ে অবস্থাটা ঠিক বােঝানাে ভারি শক্ত, তাই মনে করেছিলুম আস্তে আস্তে তোমাকে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব— কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের সুবিধামত ধীরে-সুস্থে কিছুই ঘটতে চায় না— ঘটনাগুলোও শিকারি বাঘের মতো প্রথমটা গুড়ি মেরে \b||V)Գ