পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏊᏠᎸ রবীন্দ্র-রচনাবলী মেরে নিঃশব্দে চলে, তার পরে হঠাৎ এক সময় ঘাড়ের উপরে লাফ দিয়ে এসে পড়ে। আবার তার সংবাদও আগুনের মতো প্রথমটা চাপা থাকে, তার পরে হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, তখন তাকে আর সামলানো যায় না। সেইজনেই এক এক সময় মনে হয়, কর্মমাত্রই ত্যাগ করে একেবারে স্থাণু হয়ে বসে থাকাই মানুষের পক্ষে মুক্তি ।” গোরা হাসিয়া কহিল, “তুমি একলা স্থাণু হয়ে বসে থাকলেই বা মুক্তি কোথায় ? সেইসঙ্গে জগৎ-সূদ্ধ যদি স্থাণু হয়ে না। ওঠে তা হলে তোমাকে স্থির থাকতে দেবে কেন ? সে আরো উলটাে বিপদ হবে । জগৎ যখন কাজ করছে তখন তুমিও যদি কাজ না কর তা হলে যে কেবলই ঠেকবে। সেইজন্যে এইটে দেখতে হবে ঘটনা যেন তোমার সতর্কতাকে ডিঙিয়ে না যায়- এটা না হয় যে, আর-সমস্তই চলছে, কেবল তুমিই প্রস্তুত নেই।” বিনয় কহিল, “ঐ কথাটাই ঠিক। আমিই প্ৰস্তুত থাকি নে । এবারেও আমি প্ৰস্তুত ছিলুম না। কোন দিক দিয়ে কী ঘটছে তা বুঝতেই পারি নি। কিন্তু যখন ঘটে উঠল তখন তার দায়িত্ব তো গ্ৰহণ করতেই হবে । যেটা গোড়াতে না ঘটলেই ভালো ছিল সেটাকে আজ অপ্রিয় হলেও তো অস্বীকার করা যায় না।” গুরু কলি, “কটা কী ন জেনে স্টের সম্বন্ধে আলােচনায় যোগ দেওয়া আমার পক্ষে জায়গায় এসে দাড়িয়েছে যে, তাকে যদি আমি বিবাহ না করি তবে চিরজীবন সমাজে তাকে অন্যায় এবং অমূলক অপমান সহ্য করতে হবে।” গোরা কহিল, “কী রকমটা দাড়িয়েছে শুনি ।” বিনয় কহিল, “সে অনেক কথা । সে ক্রমে তোমাকে বলব, কিন্তু ওটুকু তুমি মেনেই নাও ।” গোরা কহিল, “আচ্ছা, মেনেই নিচ্ছি। ও সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, ঘটনা। যদি অনিবাৰ্য হয় তার দুঃখও অনিবাৰ্য। সমাজে যদি ললিতাকে অপমান ভোগ করতেই হয় তো তার উপায় নেই।” বিনয় কহিল, “কিন্তু সেটা নিবারণ করা তো আমার হাতে আছে।” গোরা কহিল, “যদি থাকে তো ভালোই । কিন্তু গায়ের জোরে সে কথা বললে তো হবে না । অভাবে পড়লে চুরি করা, খুন করাও তো মানুষের হাতে আছে, কিন্তু সেটা কি সত্যি আছে ? ললিতাকে বিবাহ করে তুমি ললিতার প্রতি কর্তব্য করতে চাও, কিন্তু সেইটেই কি তোমার চরম কর্তব্য ? সমাজের প্রতি কর্তব্য নেই ?” সমাজের প্রতি কর্তব্য স্মরণ করিয়াই বিনয় ব্ৰাহ্মবিবাহে সম্মত হয় নাই সে কথা সে বলিল না, তাহার তর্ক চড়িয়া উঠিল । সে কহিল, “ঐ জায়গায় তোমার সঙ্গে বোধ হয় আমার মিল হবে না । আমি তো ব্যক্তির দিকে টেনে সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলছি নে । আমি বলছি, ব্যক্তি এবং সমাজ দুইয়ের উপরেই একটি ধর্ম আছে- সেইটের উপরে দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। যেমন ব্যক্তিকে বঁাচানোই আমার চরম কর্তব্য নয় তেমনি সমাজকে বাচানোও আমার চরম কর্তব্য নয়, একমাত্র ধর্মকে বঁাচানোই আমার চরম শ্ৰেয় ।” গোরা কহিল, “ব্যক্তিও নেই সমাজও নেই, অথচ ধর্ম আছে, এমন ধর্মকে আমি মানি নে ৷” বিনয়ের রেখ চড়িয়া উঠিল । সে কহিল, “আমি মানি । ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তির উপরে ধর্ম নয়, ধর্মের ভিত্তির উপরেই ব্যক্তি ও সমাজ । সমাজ যেটাকে চায় সেইটোকেই যদি ধর্ম বলে মানতে হয় তা হলে সমাজেরই মাথা খাওয়া হয় । সমাজ যদি আমার কোনো ন্যায়সংগত ধর্মসংগত স্বাধীনতায় বাধা দেয় তা হলে সেই অসংগত বাধা লঙঘন করলেই সমাজের প্রতি কর্তব্য করা হয় । ললিতাকে বিবাহ করা যদি আমার অন্যায় না হয়, এমন-কি, উচিত হয়, তবে সমাজ প্রতিকুল বলেই তার থেকে নিরস্ত হওয়া আমার পক্ষে অধৰ্ম হবে ।” গোরা কহিল, “ন্যায় অন্যায় কি একলা তোমার মধ্যেই বদ্ধ ? এই বিবাহের দ্বারা তোমার ভাবী