পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(ሰዓ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী লাগিল ; সে অসহিষ্ণু হইয়া কহিল, “দেখো অবিনাশ, তোমরা ভক্তির দ্বারাই মানুষকে অপমান কর— রাস্তার ধারে আমাকে নিয়ে তোমরা সঙের নাচন নাচাতে চাও সেটা প্রত্যাখ্যান করতে পারি, এতটুকু লজ্জাশরাম তোমরা আমার কাছে প্রত্যাশা কর না ! একেই তোমরা বল মহাপুরুষের লক্ষণ ! আমাদের এই দেশটাকে কি তোমরা কেবলমাত্র একটা যাত্রার দল বলে ঠিক করে রেখেছ ? সকলেই প্যালা নেবার জন্যে কেবল নেচে বেড়াচ্ছে! কেউ এতটুকু সত্যকাজ করছে না ! সঙ্গে যোগ দিতে চাও ভালো, ঝগড়া করতে চাও সেও ভালো, কিন্তু দোহাই তোমাদের- আমন করে বাহবা দিয়ে না।” অবিনাশের ভক্তি আরো চড়িতে লাগিল। সে সহাস্যমুখে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মুখের দিকে চাহিয়া গোরার বাক্যগুলির চমৎকারিতার প্রতি সকলের মন আকর্ষণ করিবার ভাব দেখাইল | কহিল, “আশীর্বাদ করুন, আপনার মতো ঐরকম নিষ্কামভাবে ভারতবর্ষের সনাতন গৌরব-রক্ষার জন্যে আমরা জীবন সমাপণ করতে পারি।” এই বলিয়া পায়ের ধূলা লইবার জন্য অবিনাশ হস্ত প্রসারণ করিতেই গোরা সরিয়া গেল । অবিনাশ কহিল, “গীেরমোহনবাবু, আপনি তো আমাদের কাছ থেকে কোনো সম্মান নেবেন না। কিন্তু আমাদের আনন্দ দিতে বিমুখ হলেও চলবে না। আপনাকে নিয়ে একদিন আমরা সকলে মিলে আহার করব। এই আমরা পরামর্শ করেছি- এটিতে আপনাকে সম্মতি দিতেই হবে ।” গোরা কহিল, “আমি প্ৰায়শ্চিত্ত না করে তোমাদের সকলের সঙ্গে খেতে বসতে পারব না ।” প্ৰায়শ্চিত্ত ! অবিনাশের দুই চক্ষু দীপ্ত হইয়া উঠিল। সে কহিল, “এ কথা আমাদের কারও মনেও উদয় হয় নি, কিন্তু হিন্দুধর্মের কোনো বিধান গীেরমোহনবাবুকে কিছুতে এড়াতে পারবে না ।” সকলে কহিল- তা বেশ কথা । প্ৰায়শ্চিত্ত উপলক্ষেই সকলে একত্রে আহার করা যাইবে । সেদিন দেশের বড়ো বড়ো অধ্যাপক-পণ্ডিতদের নিমন্ত্ৰণ করিতে হইবে ; হিন্দুধর্ম যে আজও কিরূপ সজীব আছে তাহা গৌরমোহনবাবুর এই প্ৰায়শ্চিত্তের নিমন্ত্রণে প্রচার হইবে । প্ৰায়শ্চিত্তসভা কবে কোথায় আহূত হইবে সে প্রশ্নও উঠিল। গোরা কহিল, এ বাড়িতে সুবিধা হইবে না । একজন ভক্ত তাহার গঙ্গার ধারের বাগানে এই ক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রস্তাব করিল । ইহার খরচও দলের লোকে সকলে মিলিয়া বহন করিবে স্থির হইয়া গেল । বিদায়গ্রহণের সময় অবিনাশ উঠিয়া দাড়াইয়া বক্তৃতার ছাদে হাত নাড়িয়া সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “গৌরমোহনবাবু বিরক্ত হতে পারেন— কিন্তু আজ আমার হৃদয় যখন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তখন এ কথা না বলেও আমি থাকতে পারছি নে, বেদ-উদ্ধারের জন্যে আমাদের এই পুণ্যভূমিতে অবতার জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তেমনি হিন্দুধর্মকে উদ্ধার করবার জন্যেই আজ আমরা এই অবতারকে পেয়েছি। পৃথিবীতে কেবল আমাদের দেশেই ষড়ঋতু আছে, আমাদের এই দেশেই কালে কালে অবতার জন্মেছেন এবং আরো জন্মাবেন । আমরা ধন্য যে সেই সত্য আমাদের কাছে প্ৰমাণ হয়ে গেল ! বলে ভাই, গৌরমোহনের জয় ।” অবিনাশের বাগিতায় বিচলিত হইয়া সকলে মিলিয়া গৌরমোহনের জয়ধ্বনি করিতে লাগিল । গোরা মর্মান্তিক পীড়া পাইয়া সেখান হইতে ছুটিয়া চলিয়া গেল । আজ জেলখানা হইতে মুক্তির দিনে প্রবল একটা অবসাদ গোরার মনকে আক্রমণ করিল। নূতন উৎসাহে দেশের জন্য কাজ করিবে বলিয়া গোরা জেলের অবরোধে অনেক দিন কল্পনা করিয়াছে । আজ সে নিজেকে কেবল এই প্রশ্ন করিতে লাগিল— ‘হায়, আমার দেশ কোথায় ! দেশ কি কেবল আমার একলার কাছে ! আমার জীবনের সমস্ত সংকল্প যাহার সঙ্গে আলোচনা করিলাম সেই আমার আশৈশবের বন্ধু আজ এতদিন পরে কেবল একজন স্ত্রীলোককে বিবাহ করিবার উপলক্ষে তাহার দেশের সমস্ত অতীত ও ভবিষ্যতের সঙ্গে এক মুহুর্তে এমন নির্মমভাবে পৃথক হইতে প্ৰস্তুত হইল । আর যাহাদিগকে সকলে আমার দলের লোক বলে, এতদিন তাহাদিগকে এত বুঝানোর পরও তাহারা আজ এই স্থির করিল যে, আমি কেবল হিন্দুয়ানি উদ্ধার করিবার জন্য অবতার হইয়া জন্মগ্রহণ করিযাছি ! আমি কেবল মূর্তিমান শাস্ত্রের বচন ! আর, ভারতবর্ষ কোনোখানে স্থান পাইল না !