পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা (፩ ዓ S মাথা তুলিয়া গেল। সত্যের দিকেই ঝুঁকিয়াছে বলিয়া তাহার এত জোর, না, ঝোকটা আর-কিছুর দিকে সে কথা বিনয়ের বুঝিবার অবস্থা ছিল না। হরিমোহিনী তখন রন্ধনের উদযোগ করিতেছিলেন । বিনয় সেখানে রন্ধনশালার দ্বারে ব্রাহ্মণতনয়ের মধ্যাহ্নভোজনের দাবি মঞ্জর করাইয়া উপরে চলিয়া গেল। সুচরিতা একটা সেলাইয়ের কােজ লইয়া সেই দিকে চােখ নামাইয়া অঙ্গুলিচালনা করিতে করিতে আলোচা কথাটা পাড়িল । কহিল, “দেখুন বিনয়বাবু, ভিতরকার বাধা যেখানে নেই। সেখানে বাইরের প্রতিকূলতাকে কি মেনে চলতে হবে ?” গোরার সঙ্গে যখন তর্ক হইয়াছিল তখন বিনয় বিরুদ্ধ যুক্তি প্রয়োগ করিয়াছে। আবার সুচরিতার সঙ্গে যখন আলোচনা হইতে লাগিল তখনো সে উলটা পক্ষের যুক্তি প্রয়োগ করিল। তখন গোরার সঙ্গে তাহার যে কোনো মতবিরোধ আছে এমন কথা কে মনে করিতে পরিবে ! বিনয় কহিল, “দিদি, বাইরের বাধাকে তোমরাও তো খাটাে করে দেখছি না ।” সুচরিতা কহিল, “তার কারণ আছে বিনয়বাবু! আমাদের বাধাটা ঠিক বাইরের বাধা নয়। আমাদের সমাজ যে আমাদের ধর্মবিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত । কিন্তু আপনি যে-সমাজে আছেন সেখানে আপনার বন্ধন কেবলমাত্ৰ সামাজিক বন্ধন । এইজন্যে যদি ললিতাকে ব্ৰাহ্মসমাজ পরিত্যাগ করে যেতে হয় তার সেটাতে যত গুরুতর ক্ষতি, আপনার সমাজত্যাগে আপনার ততটা ক্ষতি নয় ।” ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত সাধনার জিনিস, তাহাকে কোনো সমাজের সঙ্গে জড়িত করা উচিত নহে 4ई निशा दिन्श ऊर्क कप्तिङ व्लानि | এমন সময় সতীশ একখানি চিঠি ও একটি ইংরাজি কাগজ লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। বিনয়কে দেখিয়া সে অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিল— শুক্রবারকে কোনো উপায়ে রবিবার করিয়া তুলিবার জনা তাহার মন বাস্ত হইতে লাগিল । দেখিতে দেখিতে বিনয়ে এবং সতীশে মিলিয়া সভা জমিয়া গেল এ দিকে ললিতার চিঠি এবং তৎসহ প্রেরিত কাগজখানি সুচরিতা পড়িতে লাগিল। এই ব্ৰাহ্ম কাগজটিতে একটি খবর ছিল যে, কোনো বিখ্যাত ব্ৰহ্মপরিবারে হিন্দু-সমাজের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধ ঘটিবার যে আশঙ্কা হইয়াছিল তাহা হিন্দুযুবকের অসম্মতিবশত কাটিয়া গিয়াছে। এই আক্ষেপ প্ৰকাশ করা হইয়াছে । সুচবিতা মনে মনে কহিল, যেমন করিয়া হউক, বিনয়ের সহিত ললিতার বিবাহ ঘটাইতেই হইবে। কিন্তু সে তো এই যুবকের সঙ্গে তর্ক করিয়া হইবে না। ললিতাকে সুচরিতা তাহার বাড়িতে আসিবার জনা চিঠি লিখিয়া দিল, তাহাতে বলিল না যে, বিনয় এখানে আছে। কোনো পঞ্জিকাতেই কোনো গ্ৰহনক্ষত্রের সমাবেশে শুক্রবারে রবিবার পড়িবার ব্যবস্থা না থাকায় সতীশকে ইস্কুলে যাইতে প্রস্তুত হইবার জন্য উঠতে হইল। সুচরিতাও স্নান করিতে যাইতে হইবে বলিয়া কিছুক্ষণের জন্য অবকাশ প্রার্থনা করিয়া চলিয়া গেল। তর্কের উত্তেজনা যখন কাটিয়া গেল তখন সুচরিতার সেই একলা ঘরটিতে বসিয়া বিনয়ের ভিতরকার যুবাপুরুষটি জাগিয়া উঠিল। বেলা তখন নয়টা সাড়ে নয়টা । গলির ভিতরে জনকোলাহল নাই । সুচরিতার লিখিবার টেবিলের উপর একটি ছােটাে ঘড়ি টিক টিক করিয়া চলিতেছে। ঘরের একটি প্রভাব বিনয়কে আবিষ্ট করিয়া ধরিতে লাগিল। চারিদিকের ছােটােখাটাে গৃহসজ্জাগুলি বিনয়ের সঙ্গে যেন আলাপ জুডিয়া দিল। টেবিলের উপরকার পারিপাটা, সেলাইয়ের কাজ-করা চোকি-ঢাকাটি, চীকির নীচে পদস্থানের কাছে বিছানাে একটা হরিণের চামড়া, দেয়ালে ঝোলানাে দুটি-চারটি ছবি, পশ্চাতে লাল সালু দিয়া মােড়া বই সাজানাে বইয়ের ছােটাে শেলফট, সমস্তই বিনয়ের চিত্তের মধ্যে একটি গভীরতর সুর বাজাইয়া তুলিতে লাগিল। এই ঘরের ভিতরটিতে একটি কী সুন্দর রহস্য সঞ্চিত ইয়া আছে। এই ঘরে নির্জন মধ্যাহ্নে সখীতে সখীতে যে-সকল মনের কথা আলোচনা হইয়া গেছে তাহাদের সলজ্জ সুন্দর সত্তা এখনাে যেন ইতস্তত প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে; কথা আলোচনা করিবার সময়