পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

QbrWり রবীন্দ্র-রচনাবলী ফেলে চুপ করে বসে থাকাও ওঁর কর্তব্য নয়।” পরেশবাবু কহিলেন, “চুপ করে না থেকে চঞ্চল হয়ে উঠলে জালে আরো বেশি করে গ্রন্থি পড়ে। কিছু একটা করাকেই যে কর্তব্য বলে তা নয়, অনেক সময় কিছু না করাই হচ্ছে সকলের চেয়ে বড়ো কর্তব্য ।” বরদাসুন্দরী কহিলেন, “তা হবে, আমি মুখ মানুষ, সব কথা ভালো বুঝতে পারি নে। এখন কী স্থির হল সেই কথাটা জেনে যেতে চাই- আমার অনেক কাজ আছে।” বিনয় কহিল, “পরশু রবিবারেই আমি দীক্ষা গ্ৰহণ করব । আমার ইচ্ছা যদি পারেশবাবু—” পরেশবাবু কহিলেন, “যে দীক্ষার কোনো ফল আমার পরিবার আশা করতে পারে সে দীক্ষা আমার দ্বারা হতে পারবে না। ব্ৰাহ্মসমাজে তোমাকে আবেদন করতে হবে।” বিনয়ের মন তৎক্ষণাৎ সংকুচিত হইয়া গেল। ব্ৰাহ্মসমাজে দস্তুরমত দীক্ষার জন্য আবেদন করার মতো মনের অবস্থা তো তাহার নহে- বিশেষত ললিতাকে লইয়া যে ব্ৰাহ্মসমাজে তাহার সম্বন্ধে এত আলোচনা হইয়া গেছে। কোন লজ্জায় কী ভাষায় সে চিঠি লিখিবে ? সে চিঠি যখন ব্ৰাহ্ম-পত্রিকায় প্রকাশিত হইবে তখন সে কেমন করিয়া মাথা তুলিবে ? সে চিঠি গোরা পড়িবে, আনন্দময়ী পড়িবেন । সে চিঠির সঙ্গে আর তো কোনো ইতিহাস থাকিবে না— তাহাতে কেবল এই কথাটুকুই প্রকাশ পাইবে যে, ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্ৰহণ করিবার জন্য বিনয়ের চিত্ত অকস্মাৎ পিপাসু হইয়া উঠিয়াছে। কথাটা তো এতখানি সত্য নহে— তাহাকে আরো-কিছুর সঙ্গে জড়িত করিয়া না দেখিলে তাহার তো লজ্জােরক্ষার আবরণটুকু থাকে না । বিনয়কে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বরদাসুন্দরী ভয় পাইলেন । তিনি কহিলেন, “উনি ব্ৰাহ্মসমাজের তো কাউকে চেনেন না, আমরাই সব বন্দোবস্ত করে দেব । আমি আজ এখনই পানুবাবুকে ডেকে পাঠাচ্ছি। আর তো সময় নেই— পরশু যে রবিবার ।” এমন সময় দেখা গেল সুধীর ঘরের সামনে দিয়া উপরের তলায় যাইতেছে। বরদাসুন্দরী তাহাকে ডাকিয়া কহিলেন, “সুধীর, বিনয় পরশু আমাদের সমাজে দীক্ষা নেবেন ।” সুধীর অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল । সুধীর মনে মনে বিনয়ের একজন বিশেষ ভক্ত ছিল ; বিনয়কে ব্ৰাহ্মসমাজে পাওয়া যাইবে শুনিয়া তাহার ভারি উৎসাহ হইল। বিনয় যেরকম ইংরেজি লিখিতে পারে, তাহার যেরকম বিদ্যাবুদ্ধি, তাহাতে ব্ৰাহ্মসমাজে যোগ না দেওয়াই তাহার পক্ষে অত্যন্ত অসংগত বলিয়া সুধীরের বােধ হইত। বিনয়ের মতো লোক যে কোনােমতেই ব্ৰাহ্মসমাজের বাহিরে থাকিতে পারে না ইহারই প্রমাণ পাইয়া তাহার বক্ষ স্ফীত হইয়া উঠিল । সে কহিল, “কিন্তু পরশু রবিবারের মধ্যেই কি হয়ে উঠবে ? অনেকেই খবর জানতে পারবে না ।” সুধীরের ইচ্ছা, বিনয়ের এই দীক্ষাকে একটা দৃষ্টাস্তের মতো সর্বসাধারণের সম্মুখে ঘোষণা করা হয় । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “না না, এই রবিবারেই হয়ে যাবে। সুধীর, তুমি দৌড়ে যাও, পানুবাবুকে শীঘ্ৰ (\g(<f ୯୩୩ ।” যে হতভাগ্যের দৃষ্টাস্তের দ্বারা সুধীর ব্রাহ্মসমাজকে অজেয়শক্তিশালী বলিয়া সর্বত্র প্রচার করিবার কল্পনায় উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিল, তাহার চিত্ত তখন সংকুচিত হইয়া একেবারে বিন্দুবৎ হইয় আসিয়াছিল। যে জিনিসটা মনে মনে কেবল তর্কে যুক্তিতে বিশেষ কিছুই নহে, তাহারই বাহ্য চেহারাটা পানুবাবুকে ডাক পড়িতেই বিনয় উঠিয়া পড়িল । বরদাসুন্দরী কহিলেন, “একটু বোসো, পানুবাবু এখনই আসবেন, দেরি হবে না ।” বিনয় কহিল, “না। আমাকে মাপ করবেন।” সে এই বেষ্টন হইতে দূরে সরিয়া গিয়া ফাকায় সকল কথা ভালো করিয়া চিন্তা করিবার অবসর পাইলে বঁাচে । বিনয় উঠতেই পরেশবাবু উঠিলেন এবং তাহার কাধের উপর একটা হাত রাখিয়া কহিলেন, “বিনয়,