পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

じ○br রবীন্দ্র-রচনাবলী গোরা যখন বলিল সে এ সংবাদ জানে না। তখন মহিম প্ৰথমে বিশ্বাস করিলেন না, তার পরে বিনয়ের এই গভীর ছদ্মব্যবহারে বার বার বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন । এবং বলিয়া গেলেন, স্পষ্টবাক্যে শশিমুখীকে বিবাহে সম্মতি দিয়া তাহার পরেও যখন বিনয় কথা নড়াচড় করিতে লাগিল তখনই আমাদের বােঝা উচিত ছিল তাহার সর্বনাশের সূত্রপাত হইয়াছে। অবিনাশ হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া কহিল, “ গৌরমোহনবাবু, এ কী কাণ্ড ! এ যে আমাদের স্বপ্নের অগোচর ! বিনয়বাবুর শেষকালে—” অবিনাশ কথা শেষ করিতেই পারিল না । বিনয়ের এই লাঞ্ছনায় তাহার মনে এত আনন্দ বোধ হইতেছিল যে, দুশ্চিন্তার ভান করা তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়ছিল। দেখিতে দেখিতে গোরার দলের প্রধান প্রধান সকল লোকই আসিয়া জুটিল । বিনয়কে লইয়া তাহাদের মধ্যে খুব একটা উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা চলিতে লাগিল । অধিকাংশ লোকই একবাক্যে বলিল- বর্তমান ঘটনায় বিস্ময়ের বিষয় কিছুই নাই, কারণ বিনয়ের ব্যবহারে তাহারা বরাবরই একটা দ্বিধা এবং দুর্বলতার লক্ষণ দেখিয়া আসিয়াছে, বস্তুত তাহাদের দলের মধ্যে বিনয় কোনোদিনই কায়মনোবাক্যে আত্মসমপণ করে নাই। অনেকেই কহিল- বিনয় গোড়া হইতেই নিজেকে কোনোক্রমে গৌরমোহনের সমকক্ষ বলিয়া চালাইয়া দিতে চেষ্টা করিত ইহা তাহাদের অসহ্য বোধ হইত। অন্য সকলে যেখানে ভক্তির সংকোচে গৌরমোহনের সহিত যথোচিত দূরত্ব রক্ষা করিয়া চলিত সেখানে বিনয় গায়ে পডিয়া গোরার সঙ্গে এমন একটা মাখামাখি করিত যেন সে আর-সকলের সঙ্গে পৃথক এবং গােরার ঠিক সমশ্রেণীর লোক, গােরা তাহাকে স্নেহ করিত বলিয়াই তাহার এই অদ্ভুত স্পর্ধা সকলে সহ্য করিয়া যাইত— সেইপ্রকার অবাধ অহংকারেরই এইরূপ শোচনীয় পরিণাম হইয়া থাকে । তাহারা কহিল— ‘‘আমরা বিনয়বাবুর মতো বিদ্বান নই, আমাদের অত অত্যন্ত বেশি বুদ্ধিও নাই, কিন্তু বাপু, আমরা বরাবর যা-হয় একটা প্রিন্সিপল ধরিয়া চলিয়াছি, আমাদের মনে এক মুখে আর নাই ; আমাদের দ্বারা আজ একরকম কাল অন্যরকম অসম্ভব— ইহাতে আমাদিগকে মুখই বলো, নির্বোধই বলো, আর যাই বলে ।” গোরা এ-সব কথায় একটি কথাও যোগ করিল না, স্থির হইয়া বসিয়া রহিল । বেলা হইয়া গেলে যখন একে একে সকলে চলিয়া গেল তখন গোরা দেখিল, বিনয় তাহার ঘরে প্রবেশ না করিয়া পাশের সিঁড়ি দিয়া উপরে চলিয়া যাইতেছে। গোরা তাড়াতাড়ি ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল ; ডাকিল, “বিনয় ।” বিনয় সিঁড়ি হইতে নামিয়া গোরার ঘরে প্রবেশ করিতেই গোরা কহিল, “বিনয়, আমি কি না জেনে তোমার প্রতি কোনো অন্যায় করেছি, তুমি আমাকে যেন ত্যাগ করেছ বলে মনে হচ্ছে।” আজ গোরার সঙ্গে একটা ঝগড়া বাধিবে এ কথা বিনয় আগেভাগেই স্থির করিয়া মনটাকে কঠিন করিয়াই আসিয়াছিল। এমন সময় বিনয় আসিয়া গোরার মুখ যখন বিমর্ষ দেখিল এবং তাঁহার কণ্ঠস্বরে একটা মেহের বেদনা যখন অনুভব করিল, তখন সে জোর করিয়া মনকে যে বাধিয়া আসিয়াছিল তাহা এক মুহূর্তেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া গেল । সে বলিয়া উঠিল, “ভাই গোরা, তুমি আমাকে ভুল বুঝে না। জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে, অনেক জিনিস ত্যাগ করতে হয়, কিন্তু তাই বলে বন্ধুত্ব কেন ত্যাগ করব।” গোরা কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “বিনয়, তুমি কি ব্ৰাহ্মসমাজে দীক্ষা গ্ৰহণ করেছ ?” ན་མའི”ལ། গোরা, করি নি, এবং করবও না । কিন্তু সেটার উপর আমি কোনো জোর দিতে (ଲ ।” গোরা কহিল, “তার মানে কী ?” বিনয় কহিল, “তার মানে এই যে, আমি ব্ৰাহ্মধর্মে দীক্ষা নিলুম কি না-নিলুম, সেই কথাটাকে অত্যন্ত তুমুল করে তোলবার মতো মনের ভাব আমার এখন আর নেই।”